Pages

Tuesday, January 29, 2019

ভিখারিণী


মূল গল্পঃ Trick or Treat
লেখকঃ Judith Garner
অনুবাদ নয়, অনুসারে লেখা।

***

সন্ধ্যের পর এদিকটায় ঝপ্‌ করে অন্ধকার নামে, তাই টর্চটা সঙ্গে রাখেন অরিজিৎ। এমনিতে কমপ্লেক্সটা ভাল, ভয়ডরের কিছু নেই, তবে ঐ – সাপখোপের কথা তো বলা যায় না। আলো একটা সঙ্গে থাকা ভাল।

চাকরিজীবনে সন্ধ্যের আগে হাঁটা হয়ে উঠত না অরিজিতের। ঐ, অফিস থেকে ফিরে ডিনারটিনার করে তবে। সেটাই বজায় রেখেছেন।

এখানে এসেছেন প্রায় বছরতিনেক হল। ছেলে-মেয়ে বাইরে থাকে, তাই রিটায়ার করার পর এইরকম একটা জায়গায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অরিজিৎ। বাজার – সে বিগ হোক বা স্মল – তো আছেই, তার সঙ্গে জিম, ক্লাব, লাইব্রেরি, ছোটদের স্কুল, মায় ডাক্তারসমেত একটা ছোটখাট ক্লিনিক।

নাঃ, শহরটাকে লন্ডন না করতে পারলেও ভেতরে একটা ছোট্ট দ্বীপের মত বানিয়ে নিয়েছে বটে! বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলেও জীবন কেটে যায় এখানে। আর অবসরপ্রাপ্ত হলে তো কথাই নেই।

*

“দশটা টাকা দেবেন বাবু?”

কারুর তো আসার কথা নয় এখানে এইসময়। গা ছমছম করে উঠল অরিজিতের।

বাচ্চা মেয়ে একটা। কত বয়স হবে? বছর দশেক? হাতে একটা পুতুল, তার গায়ে নীলের ওপর সাদা ছোপ-ছোপ জামা।

“দশটা টাকা দেবেন বাবু?”

বিরক্ত হলেন অরিজিৎ। সিকিওরিটি গার্ডগুলোর কাজ হল হকার বা ভিখিরি ঢুকতে না দেওয়া। নির্ঘাৎ বুথে বসে ঘুমোচ্ছে।

“দশটা টাকা দেবেন বাবু?”

“না, টাকা নিয়ে বেরোই না আমি।”

কথাটা ডাহা মিথ্যে, কারণ মোবাইল চাবি পার্স ছাড়া কোথাও যান না অরিজিৎ। কিন্তু একদিন দিলে এরা বারবার আসবে। আর এরপর দলবল নিয়ে এসে জ্বালাতন করবে।

“দিন না বাবু।”

নাঃ, ভবি সহজে ভোলবার নয়। পেছন ফিরে ফ্ল্যাটের দিকে হাঁটা লাগালেন অরিজিৎ। কাল সোসাইটির সেক্রেটারির কাছে একটা কমপ্লেন করতেই হবে।

*

পরের দিনটা শুয়েবসে কেটে গেল অরিজিতের। খবরের কাগজের বালাই নেই, তবে বইটই পড়েন; আর নেটফ্লিক্সের নেশাটা ক্রমশঃ সাংঘাতিক হয়ে উঠছে।

সেক্রেটারিকে জানিয়েছিলেন তিনি। একতলার বাকি পাঁচটা ফ্ল্যাটের মালিকও নাকি মেয়েটাকে দেখেছেন। সবার কাছেই ঐ এক চাহিদা তার – দশটা টাকা। তবে আর মনে হয় না এইরকম কিছু হবে।

রাত্রে একরকম জোর করেই হাঁটতে বেরোলেন। বসে থাকলেই বসে থাকা হয়। এরপর বাত, প্রেশার, সব হবে।

আজ মেয়েটা নেই দেখে বেশ নিশ্চিন্ত হলেন। সেক্রেটারির ধাতানিতে কাজ হয়েছে তাহলে।

টুথপেস্ট কেনার ছিল। যা হয়, চানাচুর নিমকি আরও রাজ্যের জাঙ্ক ফুড কিনে তবে ফিরলেন অরিজিৎ। ততক্ষণে মেয়েটার কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে।

ফ্ল্যাটের বাইরে চাবি ঘোরাতে গিয়ে জিনিসটা চোখে পড়ল। তেমন কিছু না, দরজার ঠিক পাশে মেঝের ওপর কাপড়ে মোড়া হালকা রঙের ছোট্টমত কী যেন একটা।

কুড়িয়ে নিয়ে চমকে গেলেন অরিজিৎ।

এটা একটা ডান হাত। রক্তমাংসের নয়, প্লাস্টিকের। তবে হাত যে, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। আর এই হাতের জামাটা চেনেন অরিজিৎ, কারণ এতে নীলের ওপর সাদা ছোপ-ছোপ।

হাতটা কুড়িয়ে নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরে গেলেন অরিজিৎ। ডাস্টবিনে ফেলতে গিয়েও কী ভেবে ফেললেন না। টেবিলের ওপর রেখে শুয়ে পড়লেন।

*

সকালে সেক্রেটারিকে উদ্‌ভ্রান্ত দেখাচ্ছিল। ছ’জন প্রৌঢ় যদি এসে বলেন যে তাঁদের দরজার বাইরে পুতুলের টুকরো পড়ে আছে, উদ্‌ভ্রান্ত দেখানোরই কথা।

দু’জনের দরজার বাইরে দু’টো হাত; অন্য দু’জনের ভাগ্যে দু’টো পা; আর একজনের ধড়, আর শেষজনের মাথা।

অনেক কষ্টে নানান্‌ মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে মুক্তি পেলেন সেক্রেটারি। তবে কীভাবে কী করবেন তা আদৌ বুঝতে পারলেন না তিনি।

এটা ঐ মেয়েটারই কাজ। বাজে রসিকতার একটা সীমা আছে। নির্ঘাত বেড়ার ফাঁকটাক দিয়ে কোনওভাবে ঢোকার রাস্তা খুঁজে পেয়েছে। পরের মীটিঙে কথাটা তুলতেই হবে।

*

“দশটা টাকা দেবেন বাবু?”

এটা একেবারেই আশা করেননি অরিজিৎ। সেদিনের পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে। মেয়েটার কথা তিনি ভুলেই গেছিলেন।

“দশটা টাকা দেবেন বাবু?”

খেঁকিয়ে উঠতে গিয়েও থেমে গেলেন অরিজিৎ। হাতের পুতুলটা কোত্থেকে এল? জামাটা তো সেই নীলের ওপর সাদা ছোপ-ছোপ, কিন্তু...

“দশটা টাকা দেবেন বাবু?”

হাতে পুতুলের ডানহাতটা শক্ত করে ধরা। মেয়েটা হাসছে। এ হাসির একটাই মানে হয়।

এবার হাত ধরে জোরে টান দিল মেয়েটা। আর কোল থেকে চিৎকার করে কেঁদে উঠল পুতুলটা... না না, পুতুল কোথায়...

পেটমোটা পার্সটা অজান্তেই হাতে উঠে এল অরিজিতের।

Tuesday, January 22, 2019

সুদূর দিগন্তে চাহি কল্পনায় অবগাহি...


ব্লগটা তো প্রায় মরতে বসেছে। ভাবলাম একটু অনুবাদ-টনুবাদ করি, তাতে যদি লাভ হয়। এটা ঠিক অনুবাদ নয়, ঐ, “অনুসারে”।

মূল গল্পঃ The Immortal Bard
লেখকঃ Isaac Asimov

***

“টাইম ট্র্যাভল সত্যিই সম্ভব? বলেন কী?”

সমস্যাটা আসলে অনেকদিনের। অনসূয়া আচার্য ফিজিক্স পড়ান, আর প্রিয়ংবদা পালিত পড়ান বাংলা সাহিত্য। বিজ্ঞান আর শিল্পের মধ্যে কার পাল্লা ভারী তা নিয়ে দু’জনের মধ্যে সারাক্ষণ খিটিমিটি লেগেই থাকে।

তবে অশান্তি থাকলেও এঁদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা দেখার মত। আসলে নিজের নিজের বিষয়ে দিক্‌পাল দু’জনেই। লেকচার দিতে অনসূয়ার প্রায়ই ডাক পড়ে বিশ্বের নানান্‌ প্রান্তে। নোবেল নিয়েও একটা কানাঘুষো শোনা যায়, তবে দুর্মুখেরা বলে এটা প্রিয়ংবদাকে তাতানোর জন্য সহকর্মীদের রটানো গুজব। পাত্তা না দেওয়াই ভাল।

আর প্রিয়ংবদা? বাংলা ভাষায় তাঁর পাণ্ডিত্য অপরিসীম, তবে তাঁর খ্যাতি কবিতা পড়ানোয়। অসম্ভব সাবলীল তাঁর পড়ানোর ভঙ্গি। যুক্তি দিয়ে প্রতিটা পঙক্তির অচেনা অজানা মানে এত সুন্দরভাবে বোঝান যে লোকে বলে – ইয়ে – প্রিয়ংবদার ক্লাসের সময় স্বয়ং অনসূয়া অকারণে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কীসব জানি ভাবেন। গুজব, বলাই বাহুল্য ।

আজও দু’জনের তর্ক বাধতে চলেছিল, এমন সময় অনসূয়া তুরুপের তাসটা খেলে দিলেন।

“হ্যাঁ, প্রিয়ংবদা। শুধু সম্ভব নয়, আমি নিজে এটা করেছি।”

“তাই নাকি?” অবিশ্বাস ঝরে পড়ল প্রিয়ংবদার গলায়। “প্রমাণ করতে পারবেন?”

“প্রমাণ?” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অনসূয়া। “আগে বলবেন তো, রেখে দিতাম প্রমাণ। আমি যে শুধু অতীতে গেছি তাইই নয়, মানুষকে নিয়েও এসেছি।”

“আচ্ছা? কাকে কাকে আনলেন, শুনি?”

“কাকে আর আনব? ঐ, আর্যভট্ট, ব্রহ্মগুপ্ত, চরক, সুশ্রুত। ভাবলাম বিজ্ঞানের অগ্রগতি দেখে ওঁরা উচ্ছ্বসিত হবেন।”

“আচ্ছা? তারপর? আপনার ল্যাবে বসে চা-বিস্কুট খেলেন বুঝি?”

বিদ্রূপটা গায়ে মাখলেন না অনসূয়া। “সব শুনে প্রথমে তো ওঁরা অভিভূত। থেকেও গেলেন কিছুদিন আমার বাড়িতে। কিন্তু মানিয়ে নিতে পারলেন না, জানেন তো। সমাজ অনেক বদলে গেছে।”

অবিবাহিতা অনসূয়াকে খোঁচাটা দিতে গিয়ে রুচিতে বাধলেও একেবারে ছেড়ে দিলেন না প্রিয়ংবদা: “তারপর ফিরে গেলেন ওঁরা?”

“ফিরে গেলেন মানে – আমিই ফেরত পাঠালাম। ধরে তো আর রাখতে পারলাম না। মনে হল আরও অল্পবয়সী কাউকে ডাকি।” মুচকি হেসে প্রিয়ংবদার দিকে তাকালেন অনসূয়া। “আর তখন মনে পড়ল ওঁর কথা।”

“কার কথা?”

“তখনও উনি বিশ্বকবি হননি, জানেন...”

চায়ের কাপটা ভাগ্যিস নামিয়ে রেখেছিলেন প্রিয়ংবদা, নয়ত বিষম অনিবার্য ছিল। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন শুধু।

প্রিয়ংবদার অবস্থাটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেন অনসূয়া। তারপর শুরু করলেন। “অসম্ভব ফোকাস ছিল, জানেন তো? আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতেও কীসব লিখে ভাঁজ করে পকেটে ভরে ফেললেন। আচ্ছা, প্রকাশকের তাড়া তখনও ছিল?”

“আপনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ঠাট্টা করছেন?”

“না। সত্যিই এসেছিলেন তো”, মৃদু হেসে বললেন অনসূয়া। “কত কথা হল ওঁর লেখা নিয়ে... উনি বিশ্বাসই করলেন না এত বছর পরেও ওঁকে নিয়ে এত মাতামাতি হবে, ওঁর লেখা স্কুলকলেজে পড়ানো হবে, ওঁর গান দু’টো দেশের জাতীয় সঙ্গীত হবে... ও হ্যাঁ, দাঁড়ান দাঁড়ান, আমার কাছে প্রমাণ আছে যে উনি এসেছিলেন।”

একটা খাতা বের করে পাতা উল্টেপাল্টে প্রিয়ংবদার সামনের টেবিলে রাখলেন অনসূয়া।

“এটা কী? রবীন্দ্রনাথের একটা সই জাল করিয়ে আপনি ঠিক কী প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, অনসূয়া?”

অন্যমনস্কভাবে দেওয়ালের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন অনসূয়া। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “উনি ঠিক একই প্রশ্ন করেছিলেন, জানেন তো। আমি ওঁকে এখনকার বাংলা সিলেবাস দেখালাম, উনি আদৌ বিশ্বাস করলেন না ওটা অথেন্টিক। তাই প্রমাণ করতে হল।”

“আচ্ছা? কীভাবে প্রমাণ করলেন আপনি?”

“উপায় তো একটাই, তাই না? বললাম আমাদের কলেজে ভর্তি হয়ে যেতে। অ্যাডমিশন টেস্টে ওঁকে আটকাবে কে? আর মার্কশিট মিলিয়ে দেখার দায়িত্ব তো আমার ছিল, মনে নেই? হাজার হোক্‌, ক্লাস এইট, তাই একটু কারসাজি করতে হয়েছিল বৈকি। নামটা বদলাতে হয়েছিল অবশ্য।”

প্রিয়ংবদার মুখ দিয়ে কথাই বেরোল না।

“আর তারপর?”

“ও হ্যাঁ, একটা প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল বৈকি। দাড়িগোঁফ কামাতে হল, নয়ত ছেলেগুলো লুকঅ্যালাইক কন্টেস্টে নামিয়ে দিত নির্ঘাত।”

“আপনি বলছেন, আমি রবীন্দ্রনাথের ক্লাস নিয়েছি?” অবিশ্বাস নয়, প্রিয়ংবদার গলায় এখন বিস্ময়।

“হ্যাঁ।”

“তারপর?”

“তারপর আর কী, আপনার যা স্বভাব! আপনার সেমেস্টারে ক’জন পাশ করে আপনিও জানেন। অত টিপে টিপে নম্বর দিলে ছাত্ররা টিকবে? সব ছেড়েছুড়ে অন্য সাবজেক্টে চলে যায় বা কলেজ ছেড়ে দেয়। সত্তরজনের ক্লাসেও এবারেও একুশজন গেছে।”

“মানে...”

“হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতার ভাবার্থে উত্তরে আপনি রবীন্দ্রনাথকেই শূন্য দিয়েছিলেন। উনি ফিরে এসে শুধু বলেছিলেন, ‘এত কিছু ভেবে লিখিনি, জানেন তো...?’”