Pages

Thursday, December 26, 2019

বক্সিং ডের রূপকথা

গল্পটা ১৯৫৩র বক্সিং ডের।

ডিক ব্রিটেন্ডেন লিখেছিলেন, “নিউজিল্যান্ডের প্রত্যেক সন্তান যেন মায়ের কাছে দেশের এ বীরগাথা শুনে বড় হয়।”

সেযুগের তো বটেই, ব্রিটেন্ডেন সম্ভবতঃ নিউজিল্যান্ডের সর্বকালীন সেরা ক্রিকেটলেখক।

অথচ য়োহ্যানেসবার্গে নিউজিল্যান্ড হেরেছিল ১৩২ রানে।

কী এমন ঘটেছিল সেদিন এলিস পার্কে?

*

যে সাতটা দেশ তখন টেস্ট ক্রিকেট খেলত, তাদের মধ্যে নিউজিল্যান্ড ছিল সবথেকে দুর্বল। দু’দশকের বেশি সময় ধরে টেস্ট ক্রিকেট খেললে কী হবে, তখনও অবধি একটাও টেস্ট জেতেনি তারা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দলের হাল ধরেন ওয়ল্টর হ্যাডলী। তখন চাকা খানিকটা ঘুরতে শুরু করে। তারপর বার্ট সাটক্লিফ, মার্ভ ওয়লেসের হাত ঘুরে দায়িত্ব আসে জিওফ রাবোনের হাতে।

খুব বড় মাপের ক্রিকেটার ছিলেন না রাবোন, কিন্তু তাঁর কথা একটু না বললেই নয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে র‍্যাফে নাম লিখিয়েছিলেন এই রাবোন। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে শুধু নিজে বাঁচেননি, নিজের গোটা দলকে বাঁচিয়েছিলেন, তাও একাধিকবার।

১৯৪৪এ, বিশ্বযুদ্ধের একদম শেষ পর্যায়ে রাবোনের বোমারু বিমানে আগুন লেগে যাওয়া সত্ত্বেও বেঁচে যান তিনি। প্যারাশুট নিয়ে নামেন ফ্রান্সের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানে এক ফরাসী পরিবারের আশ্রয়ে বেঁচে যান।

আর এই সাহস, আত্মবিশ্বাস, স্নায়ুর ওপর নিয়ন্ত্রণ, সমস্ত সংক্রামিত হয়েছিল তাঁর দলের মধ্যে।

ষাটের দশকে বিশ্বের অন্যতম ক্রিকেটশক্তি হয়ে ওঠে দক্ষিণ আফ্রিকা। এ গল্প তার দশ বছরেরও বেশি আগের, কিন্তু তাদের উত্থানের সূচনা এই সময়েই।

এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ধীরে ধীরে, সযত্নে গড়ে তুলছিলেন জ্যাক চীথম। গত বছর অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজ ড্র করে নিউজিল্যান্ডে জিতেছিল তারা। নিজের দেশে স্বভাবতঃই তাদের দাপট অনেক বেশি হওয়ার কথা।

আর হলও তাই। ডারবানে শতরান করলেন রয় ম্যাকলীন, জ্যাকি ম্যাকগ্লিউ করলেন ৮৪, আর ম্যাচে ন’উইকেট নিলেন হিউ টেফীল্ড। রাবোনের লড়াকু ব্যাটিং সত্ত্বেও ইনিংসে হারল নিউজিল্যান্ড।

য়োহ্যানেসবার্গ টেস্টের ব্যাপারে লেখার আগে দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং আক্রমণের ব্যাপারে একটু বলা উচিত। নতুন বলে বিপজ্জনক ছিলেন ডেভিড আয়রনসাইড; ঘণ্টার পর ঘণ্টা একনাগাড়ে বল করেও ক্লান্ত হতেন না অ্যান্টন মারে; আর টেফীল্ড ছিলেন সম্ভবতঃ দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে সেরা স্পিনার।

ডারবানে এঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন নীল অ্যাডকক, সম্ভবতঃ সে’যুগের দ্রুততম বোলার। দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে প্রথম বিশ্বমানের ফাস্ট বোলারও তিনিই। বয়স মাত্র বাইশ, আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে, গতি কমানোর প্রশ্নই নেই। তার ওপর বিপজ্জনক বাউন্স।

আর এলিস পার্কের পিচও তো তেমন! সবুজ ঘাস, বল শুধু লাফায় তাই নয়, পিচে পড়ার পর আসে অসম্ভব গতিতে।

এই পিচেই প্রথম দিন আট উইকেটে ২৫৯ করল দক্ষিণ আফ্রিকা। তার মধ্যে ৯৩ করলেন রাসেল এন্ডীন, আর ক্লাইভ ফান রাইনেভেল্ড করলেন ৬৫। টনি ম্যাকগিবন শেষবেলায় পরপর দু’উইকেট না পেলে আরেকটু বেশি হত হয়ত।

*

ওয়েলিংটন থেকে অকল্যান্ডে যাওয়ার পথে যখন টাঙ্গিওয়াই পেরোল ট্রেনটা, রাত তখন দশটা পেরিয়ে গেছে। সামনে এবার ওয়াঙ্গাহু নদীর ব্রিজ।

দুর্ভাগ্যবশতঃ, সেদিনই যে এই ব্রিজের একটা খিলান ভেঙে পড়েছিল, তা ট্রেনের কর্মচারী বা দু’শো চুরাশি জন যাত্রীর কেউই জানতেন না।

চেষ্টা একটা হয়েছিল বৈকি। ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়েছিলেন জনৈক সিরিল এলিস। ট্রেন আসছে দেখে টর্চ জ্বেলে সতর্ক করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। এমার্জেন্সি ব্রেক চাপেন ড্রাইভার চার্লস পার্কার। “স্যান্ডিং” করে গতি আরও কমিয়ে দেন ফায়রম্যান লান্স রেডম্যান।

কিছু মানুষ বাঁচলেন এর ফলে। কিন্তু এঞ্জিন, টেন্ডার, আর দ্বিতীয় শ্রেণীর পাঁচটা কামরা সমেত শেষ অবধি ওয়াঙ্গাহুতে আছড়ে পড়ল ট্রেন।

টাঙ্গিওয়াইয়ে রাত তখন দশটা একুশ। য়োহ্যানেসবার্গে দুপুর বারোটা একুশ।

নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে এতবড় ট্রেন দুর্ঘটনা আর কখনও হয়নি। মোট একশো একান্নজন মারা যান। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বব ব্লেয়রের বাগ্‌দত্তা নেরিসা লাভ।

দুর্ঘটনার সময় এলিস পার্কে ফীল্ডিং করছিলেন একুশ বছরের ব্লেয়র। বেশ ভাল বলও করেন সেদিন। আর ফিরেই পান খবরটা।

*

পরের দিন বড়দিন। খেলার বিরতি। কিন্তু উৎসবের লেশমাত্র ছিল না নিউজিল্যান্ড শিবিরে। সবার মন তখন টাঙ্গিওয়াইয়ের দিকে। রেডিও, খবরের কাগজ, যে যেভাবে হোক যতটা সম্ভব জানার চেষ্টা করে চলেছে তখন।

তারপরের দিন খানিকটা সামলে উঠে মাঠের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন ক্রিকেটাররা। দলের সঙ্গে গেলেন না শুধু ব্লেয়র। হোটেলের ঘরে তাঁর সঙ্গী বলতে তখন শুধু রেডিও আর ম্যানেজার জন কার। তিনি যে সেদিন আসবেন না, তা মাইকে শুনতে পেল এলিস পার্কের সবাই।

২৭১ রানে শেষ হল দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস।

*

নিউজিল্যান্ডের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান সাটক্লিফ। অনেক বছর পর তিনি নির্দ্বিধায় জানান যে এলিস পার্কের এই টেস্টের মত এত দ্রুতগতির পিচ তিনি প্রায় দেখেননি বললেই চলে।

এলিস পার্কের পিচে মিডিয়ম পেসারের বাউন্সারই আসে বেশ জোরে, আর এ তো অ্যাডকক!

তবে এদিন বাউন্সার দেওয়ার চেষ্টাও তেমন করেননি সাড়ে ছ’ফুটের অ্যাডকক। নিজের উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে লেংথ থেকেই বল বাউন্স করাতে সক্ষম হলেন। শুরুতেই চোট পেলেন রাবোন, তারপর আয়রনসাইডের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গেলেন।

এবার অ্যাডককের পালা। ব্যাটটা কোনওমতে খানিকটা তুলতে পারলেন মারে চ্যাপ্‌ল্‌। বল তাঁর গ্লাভ ছুঁয়ে প্রথমে লাগল বুকে, তারপর উইকেটে।

ম্যাট পূরের সঙ্গে এবার যোগ দিতে এলেন স্বয়ং সাটক্লিফ। অ্যাডককের দু’টো বল খেলে দিলেন তিনি।

তৃতীয় বল বাউন্সার। স্বভাবতঃই হুক করতে গেলেন সাটক্লিফ।

সাটক্লিফের কানের পাশ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে দেখে স্ট্রেচার হাতে দৌড়ে এল ফার্স্ট-এডের দল, তাঁদের পুরোভাগে সদ্য আউট হওয়া রাবোন। ততক্ষণে সাটক্লিফকে ঘিরে ধরেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ফীল্ডাররা।

কোনওমতে উঠে দাঁড়ালেন সাটক্লিফ। হেঁটেই বেরোলেন মাঠ থেকে। যাওয়ার আগে চীথমের সঙ্গে হাত মেলাতেও ভুললেন না।

প্যাভিলিয়নে ফেরামাত্রই কিন্তু তাঁকে নিয়ে ছুটতে হল হাসপাতালে। এই চোটের মানসিক ধাক্কা জীবনের শেষ অধ্যায়েও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেননি সাটক্লিফ।

*

এদিকে অ্যাডককের আক্রমণে জর্জরিত হয়েও পঁচিশ মিনিট মাটি কামড়ে পড়ে রইলেন জন রীড। তিন রানের মাথায় সেই অ্যাডককের বলেই ফিরলেন তিনি।

এরপর লরি মিলারের পালা। কোনও রান করার আগেই অ্যাডককের বল আছড়ে পড়ল তাঁর বুকে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল কাশি, আর কাশির সঙ্গে রক্ত। স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে নিয়েও ছুটতে হল হাসপাতালে।

অ্যাডককের বল বুকে লেগে উইকেটে লাগায় আউট হলেন পূর, অনেকটা চ্যাপ্‌লেরই মত। নিউজিল্যান্ডের স্কোর তখন মাত্র ৩৫। দলের এগারোজনের চারজন প্যাভিলিয়নে, দু’জন হাসপাতালে, একজন হোটেলে। তখন দেড়শো রানে ফলোঅনের যুগ, অতএব দরকার আরও ৮৬।

খানিকটা লড়লেন জন বেক আর ফ্র্যাঙ্ক মূনি। তারপর অ্যাডককের বলে চোট পেলেন বেক, বল লাগল কুঁচকির ঠিক পাশে। এযাত্রা বেঁচে গেলেও আঘাতের জেরে উলটে গেল বেকের “বক্স”। ছুটে এলেন ম্যাকগ্লিউ, বেকের ব্যাটের হাতল দিয়ে কোনওমতে ঠুকে ঠুকে মেরামত করলেন।

নতুন বলটা কোনওমতে খেলে দিলেন বেক আর মূনি। কিন্তু তাতে হবে কী? মারে আর টেফীল্ডের বলে রান করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার! শেষ অবধি বাইশ করে আউট হলেন বেক।

সবাইকে চমকে দিয়ে প্যাভিলিয়নের সিঁড়ি দিয়ে তখন নেমে এলেন মিলার। হাততালিতে ফেটে পড়ল তেইশ হাজার দর্শক।

*

কাশির দমকে দমকে রক্ত বেরোনোর পর ডাক্তাররা মিলারকে মাঠে যেতে বারণ করেছিলেন। বুকে আরেকবার লাগলে মৃত্যুও হতে পারে, বলেছিলেন তাঁরা।

পাত্তা দেননি মিলার। একরকম জোর করেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন।

এবার রুখে দাঁড়ালেন তিনি। রান করলেন মাত্র চোদ্দ, কিন্তু জুটিতে চব্বিশ রান ওঠার ফলে ফলোঅন বাঁচানোর লক্ষ্যে আরেকটু এগিয়ে দিলেন নিউজিল্যান্ড।

কিন্তু দরকার যে আরও চল্লিশ! মূনি আছেন বটে, কিন্তু ব্যাটসম্যান বলতে বাকি যে শুধু দুই টেল-এন্ডার ম্যাকগিবন আর গাই ওভার্টন।

কে বাঁচাবে নিউজিল্যান্ডকে?

*

বাঁ কানের পেছনে অনেকটা ফুলে গেছিল সাটক্লিফের। “ফোলাটার মাপ আমার হাতের মুঠোর সমান,” পরে বলেছলেন নিউজিল্যান্ডের দ্বাদশ ব্যক্তি এরিক ডেম্পস্টার।

তবে হাড় ভাঙেনি, তাই কানের লতিতে সেলাই করে ছেড়ে দিতে চাইলেন ডাক্তার। তবে ঐ, ছাড়ার আগে আরেকবার কানের ফোলা জায়গাটা আঙুল দিয়ে টিপে ধরতে গেলেন।

আর তাতেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন সাটক্লিফ।

এ পরিস্থিতিতে ব্যাট করতে নামার প্রশ্নই ওঠে না, তাও আবার এলিস পার্কে অ্যাডককের সামনে।

কিন্তু সাটক্লিফকে বোঝাবে কে? যেটুকু দ্বিধা ছিল, জ্ঞান ফেরার পর গলায় খানিকটা স্কচ ঢালতেই সেটুকুও কেটে গেল।

প্যাভিলিয়নে সাটক্লিফকে থামানোর একটা শেষ চেষ্টা করেছিলেন বটে রাবোন। চটজলদি জবাব এল: “স্কোরটা দেখেছ?”

ব্যান্ডেজের ওপর ব্যান্ডেজ, স্তরের পর স্তর। কান দিয়ে রক্ত বেরিয়েই চলেছে। ব্যান্ডেজের ওপর ক্রমশঃ ফুটে উঠছে লাল ছোপ।

ক্রীজে বেশি সময় কাটানোর প্রশ্নই ওঠে না। চল্লিশ রান করা নিয়ে তো কথা!

সাতান্ন রানের জুটি গড়লেন মূনি আর সাটক্লিফ। প্রথম পঞ্চাশ রান এল ঊনচল্লিশ মিনিটে। দু’টো ক্যাচ পড়ল সাটক্লিফের। চারটে ছয় মারলেন তিনি। তারপর আউট হলেন মূনি। টিকলেন না ম্যাকগিবন আর ওভার্টনও।

ন’উইকেট পড়ে গেছে, ব্লেয়র ব্যাট করবেন না, কিন্তু আসল কাজ হয়ে গেছে। ব্যবধান কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র একশো সতেরো।

পাঁচ উইকেট নিয়েছেন আয়রনসাইড। মাঠ ছেড়ে বেরোচ্ছেন, স্বভাবতঃই উঠে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানাল গোটা স্টেডিয়ম।

কিন্তু রূপকথার আরেকটা অধ্যায় যে তখনও বাকি!

*

রেডিওয় সব শুনে ইতিমধ্যেই কারকে ট্যাক্সি ডাকতে বলে দিয়েছেন ব্লেয়র। প্যাভিলিয়নে ঢুকেই প্যাড পরতে শুরু করে দিলেন। ততক্ষণে সাটক্লিফের তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে।

ক্রীজে পৌঁছনোর পথে ব্লেয়রের কান্না প্রথম চোখে পড়ে স্কোয়্যারলেগে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যাকলীনের। হাততালি থেমে গেছে অনেকক্ষণ।

প্যাভিলিয়নের কাঁচের জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়ে তখন কান্নায় ভেঙে পড়েছে নিউজিল্যান্ডের গোটা দল। চোখের জল লুকোনোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করছেন না কেউ।

এগিয়ে এলেন সাটক্লিফ। হাত রাখলেন ব্লেয়রের কাঁধে।

“এখানে বেশিক্ষণ থাকার কোনও মানে হয় না, বলো? হাত খুলে মারতে শুরু করি বরং। কী আর হবে? বড়জোর আউট হব।”

*

ওভার শেষ। বল করতে এলেন টেফীল্ড।

প্রথম চার বলে তিনটে ছয় মারলেন সাটক্লিফ। ফেটে পড়ল গোটা মাঠ, বিশেষতঃ লংঅনের পেছনে বসে থাকা দর্শকরা।

এখানে একটা কথা বলা দরকার। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্য তখন তুঙ্গে। সারা মাঠে ছোট্ট একটা অংশে বসার অনুমতি ছিল অশ্বেতাঙ্গদের। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে যারা খেলত, এরা সাধারণতঃ তাদেরই সমর্থন করত।

মৃত্যুভয় অগ্রাহ্য করে মাথা ব্যান্ডেজে ঢেকে নেমে যদি বিপক্ষের ব্যাটসম্যান চার বলে তিনটে ছয় মারায় কী হয়েছিল, বলাই বাহুল্য।

একটা রান নিলেন সাটক্লিফ। চোয়াল শক্ত করে হাতটা চোখের ওপর একবার বুলিয়ে নিলেন ব্লেয়র।

এই ছয়টা গেল মিডউইকেটের ওপর দিয়ে।

এর আগে টেস্ট ক্রিকেটে কখনও এক ওভারে পঁচিশ রান ওঠেনি। তাও আবার টেফীল্ডের ওভারে! আট বলের ওভার, তবে পরের দু’বলে রান না হওয়া সত্ত্বেও রেকর্ড বজায় থাকল বৈকি!

সাতচল্লিশ বছর অক্ষত ছিল সাটক্লিফের রেকর্ড।

টেফীল্ড কে সেটা এখন একটু জানা দরকার। টেস্টে ওভারপিছু তিনি রান দিয়েছিলেন দু’য়েরও কম। ইংল্যান্ডের সঙ্গে একবার টানা ১৩৭ বলে কোনও রান দেননি টেফীল্ড। শুধু টেস্ট নয়, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটেও এটা বিশ্বরেকর্ড।

তবে ঐ ছ’রানের মাথায়ই স্টাম্পড হলেন ব্লেয়র, টেফীল্ডের পরের ওভারে। ছেষট্টি বলে তিপ্পান্ন রান দিলেন টেফীল্ড: টেস্ট ক্রিকেটে এত মার তিনি আর কখনও খাননি।

চারটে চার, সাতটা ছয় মেরে ১১২ মিনিটে আশি করে অপরাজিত রইলেন সাটক্লিফ। ব্লেয়রের সঙ্গে জুটিতে উঠল তেত্রিশ রান – মাত্র দশ মিনিটে।

পরস্পরের কাঁধে হাত রেখে যখন মাঠ থেকে বেরোচ্ছেন সাটক্লিফ আর ব্লেয়র, মাঠে তখন কান পাতা দায়।

রূপকথা ছাড়া আবার কী?

*

তারপর? ও হ্যাঁ, খেলার কী হল বলা দরকার বোধহয়। রীড আর ম্যাকগিবনের সামনে ৬৭ রানে ছ’উইকেট হারিয়ে বসলেও শেষ অবধি ১৪৮ তোলে দক্ষিণ আফ্রিকা।

দু’শো বত্রিশ করতে হত নিউজিল্যান্ডকে। তৃতীয় দিনের শেষে তিন উইকেট হারিয়ে ৬৮ তোলে তারা। পরের দিন সকালে অবশ্য মাত্র ১০০ রানেই ফুরিয়ে যায় তাদের ইনিংস।

Monday, December 16, 2019

ধাপে ধাপে


এ জিনিস একদিনে হয়নি। হয়না।

আর পাঁচটা বড় প্রজেক্টের মত এখানেও ওরা প্রথমে সযত্নে একটা ব্লুপ্রিন্ট বানিয়েছে। তারপর পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছে, একদিনে নয়, দুম করে নয়, আস্তে আস্তে, যেমন বড় বড় গবেষণাগারে হয়।

হিংসার মাত্রা, ফ্যাসিজমের মাত্রা একটু একটু করে বাড়িয়েছে ওরা। সঠিক ডোজটা বোঝার দরকার ছিল, তাই না? ক্রমশঃ বুঝেছে যে আমাদের মনুষ্যত্ব বলে কিছু থাকলেও তা ক্ষণস্থায়ী।

কাল রাত্রে নির্বিরোধে গুলি চালিয়ে ছাত্রদের ঘাড়ে উলটে দোষ চাপিয়েছে ওরা। আমরা খুশি হয়েছি পুলিশের এই অপরিসীম বীরত্বে, কারণ ওরা আমাদের মজ্জায় মজ্জায় ঢুকিয়ে দিয়েছে যে সমস্ত দোষ ছাত্রদের।

ঐ যে, বললাম না? একদিনে হয়নি। ধাপে ধাপে হয়েছে।

চ্যানেলগুলোকে এক এক করে ওদের কথায় ওঠবোস করতে দেখে আমাদের রাগ হয়নি। মীম বানিয়ে, শেয়র করে আমরা ভেবেছি আমাদের দায়িত্ব শেষ।

মানবাধিকারবাদীদের বাড়ি থেকে একের পর এক তুলে নিয়ে গেছে ওরা। বলেছে, ওঁরা সন্ত্রাসবাদী। আমরাও বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিয়েছি। একবারও ভাবিনি, যারা বলছে, তারাই সন্ত্রাসে হাত পাকিয়ে মসনদে বসেছে।

আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে আমাদেরই টাকা যখন নিয়েছে ওরা, আমরা তখনও বুঝিনি, কারণ আমাদের গায়ে আঁচ লাগেনি। কার্ড আছে, নেটব্যাঙ্কিং আছে, আমরা তো আর চুনোপুঁটি ব্যবসায়ী নই যে ক'দিন নগদ টাকা না জুটলে সর্বনাশ হয়ে যাবে! সোশাল মিডিয়ায় ক্যাশলেস ইকোনমির জয়ধ্বজা ওড়ানোর সহজ পন্থা বেছে নিয়েছি আমরা।

ধর্মের নামে ওরা সিনেমার, শিল্পের টুঁটি টিপে ধরার পরেও আমরা নিষ্ক্রিয় থেকেছি। মনে হয়নি, একটা মামলা অন্ততঃ করি।

সিনেমা হলে জনগণমন শুনে উঠে না দাঁড়ানো বাধ্যতামূলক না হওয়া সত্ত্বেও মার খেয়েছি একাধিকবার। গায়ে তো লাগেইনি, বরং যারা মেরেছে তাদের সমর্থনে সোচ্চার হয়েছি।

আস্তে আস্তে পায়ের তলার জমি শক্ত হয়েছে ওদের। একদিনে নয়, একটু একটু করে, ধাপে ধাপে।

তারপর ডোজ বাড়িয়েছে ওরা। সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থন করেছে। খটকা লাগলেও আমরা পাত্তা দিইনি, কারণ প্রমাণ কই?

হ্যাঁ, ওদের অপছন্দের খাবার খেলে মানুষকে যখন পিটিয়ে, কুপিয়ে মেরেছে, তখন খানিকটা শিউরে উঠেছি বৈকি। হাজার হোক, মানুষ তো! তবে ঐ, গোমাতার গায়ে হাত দিয়েছে, মারবে না তো কী করবে? বেশ করেছে!

তারপর যখন ওরা যোগাযোগের সমস্ত মাধ্যম বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, যখন একটা আস্ত রক্তমাংসের মানুষকে জীপে বেঁধে নিয়ে গেছে, নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে মেরে ছবি তুলে, ভিডিও তুলে শেয়র করেছে, আমরা তখনও বলে গেছি, “বেশ হয়েছে, দেশদ্রোহীর উচিত শিক্ষা হয়েছে।

কারণ ততদিনে আমরা শিখে গেছি। আমাদের ট্রেনিং সম্পূর্ণ হয়েছে।

বায়োমেট্রিক ডেটা চেয়েছে যখন, তখনও আমাদের টনক নড়েনি। “ফেসবুককে সব উজাড় করে দিতে পারো, সরকার চাইলেই সমস্যা?” বলে ওদের হয়ে সাফাই গেয়েছি।

ওদের বন্ধুবান্ধব সাঙ্গপাঙ্গর দলে ধর্ষকের সংখ্যা বাড়তে দেখেও কিছু মনে হয়নি আমাদের। আমার বাড়ির কারুর তো কিছু হয়নি, আমার কী?

প্রথম যেদিন স্কুলের পাঠ্যবই, শহরের নাম বদলে ফেলতে শুরু করল, সেদিনও আমাদের কিচ্ছু যায়-আসেনি। দেশের উন্নতির জন্য ভোট দিয়েছি, অমন দু'-একটা হয়েই থাকে, অত পাত্তা দিলে চলেনা।

, বললাম না? একদিনে হয়নি। ধাপে ধাপে আমাদের পোষ মানিয়েছে ওরা।

আমাদের মজ্জায় মজ্জায় ওরা ঢুকিয়ে দিয়েছে যে এটাই সুস্থ, এটাই স্বাভাবিক, এটাই ঠিক।

Sunday, October 27, 2019

পহ্‌লা অভ্‌তার


অনেকদিন ধরে লিখব-লিখব করেও নানা কারণে এটা লেখা হয়ে ওঠেনি।

প্রথমে মাছের বাজারের ব্যাপারটা বলি। আমি মূলতঃ তিনটে জায়গা থেকে মাছ কিনি:
-      বাড়ির কাছের একটা মাছের বাজার। এখানে মূলতঃ মরাঠিরা যায়। এখানে সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়, যা ওরা অসম্ভব তৎপরতার সঙ্গে কাটারি দিয়ে কাটে। “বাঙালি মাছ” বলতে পাওয়া যায় লোটে (বম্বিল) আর আমুদি (মান্ডেলি)। আমি সবরকম মাছ তৃপ্তি করে খাই, কিন্তু আমি ভালবাসলেও আঁশটে গন্ধ বাড়ির সবার মুখে রোচে না।
-      আইআইটির উল্টোদিকের বাজার। এটা বাঙালিদের আখড়া (মাছওয়ালাও বাঙালি)। এটা একটু দূরে হলেও কলকাতা থেকে মোটামুটি অনেক মাছই আসে।
-      বিগ বাজার। এটা একটু কাছে। এখানে রুই-কাতলা-পারশে তো পাওয়া যায়ই, ভেটকি-পাবদা-ট্যাংরা দিব্যি পাওয়া যায়, তবে আড়-চেতল-মৌরলা-কাজরী পাওয়া যায় না। বাড়তি সুবিধে হল এটা মলের মধ্যে, কাজেই সিনেমা দেখে বাজার করে ফেরা যায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই এখানে বাঙালি-অবাঙালি সবাই আসে।

মাছের প্রসঙ্গে বলি, কলকাতায় থাকতে বাসাকে আমি কখনও সিরিয়সলি নিইনি। এখানে এসে মনে হয়েছে হয় কলকাতারটা বাসা নয়ত বম্বেরটা। দু’টো এক মাছ হতেই পারে না। স্বাদ সম্পূর্ণ আলাদা (ভাল-খারাপ নয়; আলাদা)। তেলতেলে বড় বাসার স্বাদ অপূর্ব – তবে ঐ, যদি মাছের তেল ভাল লাগে তবেই।

কলকাতার মানুষ বম্বে ভেটকিকে যেমন তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে, আমার ধারণা বম্বের মানুষ কলকাতা বাসাকে নিয়ে একইরকম নাক সিঁটকোয়।

যাকগে, ঘটনায় ফিরি। এটা বিগ বাজারে। ও হ্যাঁ, এখানে গাদা-পেটি আলাদা করে কাটার রীতি নেই, সবই ঐ চাকা-চাকা। গাদা-পেটির জন্য আলাদাভাবে বলতে হয়; তাকে বলে বেঙ্গলি কাট।

যাকগে, আমি তো চিংড়ি ছাড়াতে আর কিছু বেঙ্গলি কাট করতে দিয়ে টুথপিক দিয়ে ফ্রী স্যাম্পল রেশমি কাবাব খাচ্ছিলাম। মাছ কাটা হয় আলাদা একটা ছোট ঘরে, বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে।

এমন সময় শুনি এক বাঙালি দম্পতি মাছ কেনার চেষ্টা করছেন। বছর ষাটেক বয়স। বুঝতে পারলাম এখানে নতুন এসেছেন, কারণ “হিঁইঁইঁইঁইঁইঁইঁইঁইঁইঁ, মাছের দাম দেখেছ?”র স্টেজটা এখনও আছে। খুব সম্ভবতঃ প্রবাসী ছেলে বা মেয়ের কাছে থাকতে এসেছেন, কারণ এই বয়সে শহর ছাড়াটা বেশ অস্বাভাবিক।

তবে হিন্দিটা, ইয়ে, আমার থেকে শুধু না, আমার মার থেকেও খারাপ, অনেকটা আমার মরাঠির সঙ্গে তুলনীয়।

যাকগে, সেদিন কাতলার ভাল স্টক ছিল। একটা বড়সড় গোছের কাতলা মাছ বাছলেন ওঁরা। কাতলাকে হিন্দিতে (সম্ভবতঃ মরাঠিতেও) কাতলাই বলে, তার ওপর লেবেল ছিল। দামের ট্যাগ থাকায় কাজেই একটা স্টেপ বাঁচল। ওজনও হয়ে গেল। এবার কাটানোর পালা।

এখানে একটা কমিউনিকেশন গ্যাপ হল। মেয়েটা যত আরতি করার মত আঙুল ঘুরিয়ে চাকা-চাকা বোঝাতে চায়, ভদ্রলোক তত ক্যারাটে চপের সাহায্যে গাদা-পেটি বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকেন। সেখানেই শেষ নয়: পাশ থেকে ভদ্রমহিলা হাত নেড়ে তারস্বরে গাদাপেটিগাদাপেটিগাদাপেটি র‍্যাপ করে চলেছেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।

শেষ অবধি মেয়েটাই সমাধান করল। জিজ্ঞেস করল, “বেঙ্গলি?”

ভদ্রমহিলা সগর্বে উত্তর দিলেন “বেঙ্গলি”।

“বেঙ্গলি কাট?”

এবার ওঁরা বেশ হকচকিয়ে গেলেন। যাওয়াটাই স্বাভাবিক। একে “বেঙ্গলি কাট” বলছে, তার ওপর পাশের ঘরে বৈদ্যুতিক করাত।

আমার হয়ত সাহায্য করা উচিত ছিল, কিন্তু আমি তখন বাকরুদ্ধ। হাতের টুথপিক হাতেই, সে আর মুখে উঠছে না।

কীভাবে যে বোঝা গেল তা ঠিক মনে নেই, তবে একটা সময় দেখলাম দু’পক্ষই বুঝে ফেলল বেঙ্গলি কাট আর ক্যারাটে চপ দুটো একই ব্যাপার।

আর তারপরেই মারাত্মক ব্যাপারটা হল।

কাটতে নিয়ে যাওয়ার ঠিক আগে ভদ্রলোক ধেয়ে এসে চিৎকার করে বললেন “পূঁছ কি কঙ্গী চাহিয়ে।”

এটা আমার রেঞ্জের বাইরে। আমি আখের রসের দোকানে “আঁখ কা রস দিজিয়ে” শুনেছি, “বঢ়িয়া”র বিপরীত হিসেবে “ছোটিয়া” শুনেছি, কিন্তু এটা অশ্রুতপূর্ব।

খানিকক্ষণ ভেবেটেবে একটা আন্দাজ করলাম। বড় কাতলার ল্যাজা বেশ মোটা হয়, কাজেই |||||||| জাতীয় একটা চিরুনিগোছের চর্বিভরা ব্যাপার থাকে, আমি বেশ ভালবাসি, নির্ঘাত ওঁদের বাড়িতেও কেউ না কেউ ভালবাসে। মাছ যেহেতু ল্যাজ আঁচড়ায় না, আমার ধারণা সেটাই বোঝাতে চাইছিলেন।

মেয়েটার জীবনেও খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রথম। রুইকাতলা থাকলে বাঙালি আসবেই, কাজেই ওরা বাঙালির হিন্দি শুনে অভ্যস্ত। আমার হিন্দি বোঝা চাট্টিখানি কথা নয়, কিন্তু দিব্যি বোঝে।

কিন্তু এটা এতই আউট অফ সিলেবাস যে মাধ্যমিকে এলে নির্ঘাত ভাঙচুর হত।

এবার ভদ্রমহিলা ফীল্ডে নামলেন। মাছটা বৈদ্যুতিক দাঁড়িপাল্লায় আবার শোয়ানো হল। তারপর দেখি ভদ্রমহিলা ল্যাজার ইঞ্চি ওপরে হাওয়ায় আঙুল দিয়ে অসম্ভব গতিতে কীসব এঁকে চলেছেন। মেয়েটাও তার উত্তরে কীসব আঁকল। দু’জনেই নীরব, কিন্তু হাত চলছে ঝড়ের গতিতে। খুব ছোট টেবিলে পিংপং খেলার মত এই ডাম শ্যারাড চলল বেশ খানিকক্ষণ।

আমি হলে পূঁছ গুটিয়ে পালাতাম, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে মেয়েটা বুঝল। কী বুঝল সেই জানে, কিন্তু দেখলাম ভদ্রমহিলা বেশ সন্তুষ্ট। দু’জনে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে মাথা নাড়লেন।

ভদ্রমহিলার হিন্দিজ্ঞান সীমিত হতে পারে, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে উনি বিশ্বের যেকোনও প্রান্তে পছন্দমাফিক মাছ কাটাতে পারতেন। মহীয়সী মহিলা।

আমার মাছ ততক্ষণে কাটানো হয়ে গেছিল। শেষ অবধি দাঁড়াইনি। আশাকরি ওঁদের পাতে সেদিন চিরুনি পড়েছিল।

Saturday, October 12, 2019

উপেনের কথা

আগেই বলে রাখি, এই পোস্টে কয়েকটা ছবি আছে। আমার ছবি আঁকার হাত জঘন্য। স্কেল মিলবে না।

*

উপেন লোকটা কয়েকদিন ধরেই বেশ ভাবাচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা লিখে রাখা ভাল।

উপেনের জমির মাপ ছিল দু’বিঘে। বিঘে বলতে ঠিক কতটা বোঝায় তা নিয়ে আমার একটা ভাসা-ভাসা ধারণা ছিল। সার্চ করতে গিয়ে দেখলাম ভারতবর্ষের আলাদা আলাদা রাজ্যে আলাদা আলাদা মাপ।

পশ্চিমবঙ্গে এক বিঘে মানে ১,৩৩৩ বর্গমিটার। বাংলাদেশে ১,৩৩৭.৮ বর্গমিটার। দু’টোর গড় ১৩৩৫.৪ বর্গমিটার। সেটা ধরেই এগোই।

অর্থাৎ দু’বিঘে মানে ২,৬৭০.৮ বর্গমিটার। বর্গাকৃতি (চৌকো) হলে তার একেকটা দিক ৫১.৬৮ মিটার গোছের। এটা খুব একটা বড় নয়। সাধারণ সুইমিং পুলের একটা দিক পঞ্চাশ মিটার হয়। মনে রাখতে হবে, এর মধ্যে বাড়ি আমগাছ সব ছিল। প্রাচীরটা ছিল কিনা নিশ্চিত নই।

তবে উপেনদের অবস্থা এককালে এর থেকে ভাল ছিল। ঋণে বাদবাকি সব জমি খুইয়ে না বসলে কত জমি ছিল বলা শক্ত। এ ব্যাপারে ইতিহাস নীরবই থেকেছে।

কিন্তু এ লেখার মূল বিষয় উপেনের পারিবারিক ইতিহাস নয়। এ লেখা ঐ জমি নিয়ে।

প্রসঙ্গতঃ, উপেন লোকটা বিশেষ সুবিধের নয়। ফিরে এসে জমির সঙ্গে বাজে ব্লেমগেম খেলেছিল। মিথ্যে ডকুমেন্ট বানিয়ে জমি কেড়ে নেওয়ায় কষ্ট হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু তার আউটবার্স্ট জমির ওপর হওয়া অনুচিত।

পুরো ব্যাপারটা এইর’ম। জমি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর “লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে” বলেটলে উপেন বেরিয়ে পড়েছিল।

সে পড়েছিল বেশ করেছিল, কিন্তু পনেরো-ষোলো বছর পর ফিরে এসে খুব অস্বস্তিকর রকমের প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ কথা বলতে শুরু করেছিল:
ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন
কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সেদিনের কোনো চিহ্ন!”

উপেন ঠিক কী আশা করেছিল কে জানে। হয়ত ভেবেছিল বাগানের মধ্যে দু’বিঘে জমি থাকবে, কিন্তু প্রচুর আদরযত্ন করা সত্ত্বেও তাতে ফলফুল কিস্যু ধরবে না।

প্রসঙ্গতঃ, সেই বাগানের আম নিতে উপেন আদৌ দ্বিধাবোধ করেনি। কোনও কারণে উপেনের ধারণা হয়েছিল যে বাগান হাতছাড়া হলেও গাছের আম নিজেরই থাকে, কাজেই প্রণামটনাম করে খাওয়ার প্ল্যান করছিল। ধরা পড়ে যাওয়ার পর অবশ্য উপেনের এই অধিকারবোধ চলে যায়। তখন আম ভিক্ষে চাওয়ার চেষ্টা করে।

তবে এসব সত্ত্বেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, আম নেওয়ার জন্য গ্রেপ্তার করা, মেরে খুন করার হুমকি দেওয়া ইত্যাদি একটু বাড়াবাড়ি।


*
 

এখানে আরেকটা ব্যাপার আছে। বাড়ি পৌঁছনোর সময়ই উপেন তৃষাতুর ছিল (গরমকালে রাস্তায় জল খায়নি কেন? গ্রামে স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল ছিল না?)। তারপর আম নিয়ে পুরো শুনানিটা হয় জলের ধারে। তখন উপেনের তেষ্টা হয়ত আরও বেড়ে গেছিল।

*

এ তো গেল উপেনের অস্বাভাবিক পোজেসিভনেসের কথা। এবার জমির কথায় আসি।

যাঁর বাগানের আকারজনিত ওসিডি নিয়ে এই কবিতা, উপেন তাঁকে চারবার “বাবু” আর দু’বার “রাজা” বলেছে (আলাদা আলাদাভাবে; “রাজাবাবু” বলেনি কখনও)। একবার “মহারাজ”ও বলেছে। “রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি” বাদ দিলাম। জমিদারকে রাজা বলাটা হয়ত স্বাভাবিক, কিন্তু উপেন লোকটা বড্ড ইনকন্সিস্টেন্ট। আমি এখানে “বাবু” বলছি।

আগেই বলছি, জমির মাপ আনুমানিক ৫০ মিটার x ৫০ মিটার, তবে সেটা বর্গাকার হলে তবেই।

কিন্তু বর্গাকার হওয়া কি সম্ভব?

কবিতার মূল বিষয় হল বাবুর বাগানের (বাবুবাগান নয়; সেটা ঢাকুরিয়ায়) আকৃতি। দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ মিলছিল না। উপেনের জমি বর্গাকৃতি হলে কিন্তু ব্যাপারটা অদ্ভুত হত। যেমন ধরা যাক, এইটা।
এখানে দু’টোই বর্গাকার। কিন্তু বাবুর সমস্যার সঙ্গে (“প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা”) মিলছে না। আর কী হতে পারত? দেখা যাক।
এটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাবুর যা বাতিক, ঐ L-শেপড জমিটুকু হয়ত নিতেনই না। আর না নিলে উপেন হয়ত ঐটুকু জায়গায় থেকে যেতেই পারত।
এ এক অবাস্তব ব্যাপার। মাটি খুঁড়ে বেরোতে হত উপেনকে। এটা হলে এমনিই বেচে দিত, সপ্তপুরুষ অর আদারওয়াইজ।

যা দাঁড়াল, জমি বর্গাকৃতি ছিল না। তার মানে আয়তাকার। গোল নয় এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, কারণ চৌকো বাগানের ভেতর গোল জমি, সেটা বেচা নিয়ে ঝামেলা – এসবের সম্ভাবনা খুব কম। একেবারে নেই বলব না, কিন্তু সে ছবি আঁকা আমার সাধ্যের বাইরে

ব্যাপারটা খুব সম্ভবতঃ নিচের ছবিটার মত ছিল।

আগেই বলেছি, মোট জমির মাপ ২,৬৭০.৮ বর্গমিটার। এবার তার প্রস্থ একটা ভদ্রস্থ কিছু ছিল নির্ঘাত। ফিতের মত ২,৬৭০ মিটার x ১ মিটার ছিল না বলেই মনে হয়। এক মিটার প্রস্থে বাড়ি বানানো অসম্ভব না হলেও হাঁটাচলা করতে গেলে উপেনকে দ্বিমাত্রিক হতে হত।

জমি ঠিক কতটা চওড়া ছিল বলা শক্ত। সুমনের কথা মাথায় রেখে দশফুট ধরি? দশফুট মানে তিন মিটার।

একটা প্রাচীরও ছিল, তবে সেটা বোধহয় বাবুর বাগানের প্রাচীর, জমির নয়। এই প্রাচীরটা একটু রহস্যময়: যে-সে ঢুকে যেকোনও গাছের নিচে বসে পড়তে পারত, কিন্তু ফল পড়লে কুড়োনোর অধিকার পেত না। 

আমসমেত গাছের ডাল প্রাচীরের বাইরে ঝুঁকে পড়তেই পারত। সেটা হলে কী হত কে জানে।

তিন মিটার প্রস্থ ধরলে দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৮৯০ মিটার। মন্দ নয়।

কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে। আমগাছ নেহাৎ রোগাপাতলা গাছ নয়। উইকিপিডিয়া বলছে ক্রাউন রেডিয়স (শাখাপ্রশাখা সব মিলিয়ে) ব্যাসার্ধ দশ মিটার। তার মানে পুরো ব্যাপারটা কুড়ি মিটার চওড়া। যদি ধরেও নিই ডালপালা সীমানার বাইরে ঝুলত, তাহলেও কমে কত হবে? পনেরো মিটার?

পনেরো মিটার হলে কিন্তু দৈর্ঘ্য ঝপ করে নেমে আসবে ১৭৮ মিটারে। আমার এক কিলোমিটার হাঁটতে মোটামুটি মিনিটদশেক লাগে, অতএব এটুকু হাঁটতে লাগবে পৌনে দু’মিনিট। জ্যৈষ্ঠমাসে অতি ভোরে উঠে তাড়াতাড়ি ছুটলে আরও অনেক কম লাগত উপেনের।

তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? জমি চওড়ায় একটা আমগাছের সমান, লম্বায় ১৭৮ মিটার।

আমরা একটা দিক একেবারে “এক আমগাছ” (খুব কমিয়ে ১৫ মিটার) ধরলে দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ১৭৮ মিটার। সেক্ষেত্রে উপেনের জমি বাদ দিলে বাবুর বাগানের মাপ হত ১৭৮ মিটার x ১৬৩ মিটার।

পনেরো মিটার না হয়ে কুড়ি মিটার হলে এই হিসেবটা বদলে যেত। অনেকটা এইর’ম দাঁড়াত।

এখানে অনেকগুলো হিসেব অ্যাপ্রক্সিমেট। যেমন ১৭৮x১৬৩-টা আসলে ১৭৮.০৫৩x১৬৩.০৫৩।


উপেনের জমি
বাবুর বাগান
(উপেনের জমি বাদ দিয়ে)
বাবুর বাগান
(উপেনের জমি সমেত)
দৈর্ঘ্য
প্রস্থ
মাপ
মাপ
(বিঘে)
দৈর্ঘ্য
প্রস্থ
মাপ
মাপ
(বিঘে)
দৈর্ঘ্য
প্রস্থ
মাপ
মাপ
(বিঘে)
১৭৮
১৫
২৬৭১
১৭৮
১৬৩
২৯০৩২
২২
১৭৮
১৭৮
৩১৭০৩
২৪
১৩৪
২০
২৬৭১
১৩৪
১১৪
১৫১৬২
১১
১৩৪
১৩৪
১৭৮৩৩
১৩
১০৭
২৫
২৬৭১
১০৭
৮২
৮৭৪২
১০৭
১০৭
১১৪১৩
৮৯
৩০
২৬৭১
৮৯
৫৯
৫২৫৫
৮৯
৮৯
৭৯২৬


আমার ব্যক্তিগত ধারণা প্রথমটাই, কারণ বাবুর জমি মনে হয় বেশ বড় ছিল বলেই মনে হয়। অবিশ্যি এইর’ম ভাবার কোনও কারণ নেই। হয়ত মাত্র চারবিঘে জমি নিয়েই উনি আরও দুবিঘে জুড়ে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ সমান করতে চাইছিলেন।

*

এই ভিডিওটার সঙ্গে এই পোস্টটার কোনও সম্পর্ক নেই। এমনিই রাখলাম।