Pages

Wednesday, February 13, 2019

অংশুমান দাশগুপ্তর অ্যাক্সিডেন্ট



মূল গল্প: Co-Incidence
লেখক: Edward D Hoch
অনুবাদ নয়, “ছায়া অবলম্বনে”

***

দোষটা অংশুমান দাশগুপ্তরই ছিল। সিসিটিভিতে দেখা গেছে তিনি দৌড়ে রাস্তা পেরোচ্ছিলেন, তাও সিগন্যাল খোলা না থাকা সত্ত্বেও। ভেজা রাস্তায় সময়মত ব্রেক করে উঠতে পারেনি ড্রাইভার।

সাধারণতঃ ছুটে রাস্তা পার হতে হত না তাঁকে, কিন্তু সেদিন বেরোতে কয়েক মিনিট দেরি হয়ে গেছিল। ঠিক তিন মিনিট সাতান্ন সেকেন্ড দেরি, আমি ঘড়ি দেখছিলাম। কেন দেখছিলাম সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

অংশুমানবাবু সাধারণতঃ ঠিক পাঁচটা সাতাশে ডেস্ক থেকে উঠে পাঁচটা একত্রিশে অফিস থেকে বেরিয়ে যেতেন। পাঁচটা চুয়াল্লিশের লোকাল ধরতেন তারপর। এতবড় পোস্টে থাকা সত্ত্বেও তিনি ট্রেনে যাতায়াত করেন – করতেন – কারণ তাতে যাতায়াত মিলিয়ে প্রায় তিনঘণ্টা বাঁচত।

ঐদিন অংশুমানবাবুকে পাঁচটা ছাব্বিশে ধরে ফেলেছিল সুজাতা, নাগপুরের আউটলেটের স্টকের ব্যাপারে কথা বলতে। কথা সামান্যই, কিন্তু মিনিটচারেক দেরি হয়ে যায় অংশুমানবাবুর। তাতেও তিনি পাঁচটা চুয়াল্লিশের আশা ছাড়েননি।

একদিন ট্রেন মিস্‌ করলে কী ক্ষতি হত কে জানে।

*

তিরিশ বছর আগে কলেজ স্ট্রীটের বইয়ের দোকানটার একটা ব্রাঞ্চ খুলেছিলেন শমীক সোম, হাজরা রোডে। তারপর হাওড়ায়। আজ দেশে একশো তিপ্পান্নটা আউটলেট। ক্রসওয়র্ড স্টারমার্কের মুখে ছাই দিয়ে এখন শম্বুক দেশের এক নম্বর বুকস্টোর।

সুজাতা শম্বুক জয়েন করেছিল পাঁচ বছর আগে। সদ্য ইউনিভার্সিটি পাশ ডেটা অ্যানালিস্ট। ওর হাত ধরে শম্বুকের সেলস তরতর করে বাড়তে থাকে।

সুজাতার কাজের পদ্ধতি আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আমি ওর তিন মাস আগে শম্বুকে এসেছিলাম, তার আগে বুকমার্কে কাজ করতাম। আমি জীবনে কখনও কাউকে এইভাবে কাজ করতে দেখিনি।

পাঁচ বছরে সুজাতা একবারও শম্বুকের কোনও স্টোরে যায়নি। যাওয়ার দরকার নেই নাকি। সেই সময়টা অফিসে বসে সারাক্ষণ কম্পিউটরে নানান্‌ সফটওয়্যার খুলে কোড লিখত। কোথায় পুনের কোন্‌ আউটলেটে একশো কুড়ি কপি হ্যারি পটার মঙ্গলবার সকালের মধ্যে পাঠাতে হবে, কবে ভুবনেশ্বর থেকে তিরিশ কপি সেলফ-হেল্প বুক সরিয়ে শেলফ ফাঁকা করতে হবে, হায়দ্রাবাদে কোন্‌ বইয়ে কত ডিসকাউন্ট দিতে হবে, এইসব জানাত দিনের শেষে ইমেল করে।

“যা যা জানার আমি তো এখানে বসেই জেনে যাচ্ছি,” ও বলত। “সব আউটলেটের সেলস, স্টোর লেআউট, বাজারে বই বিক্রির ট্রেন্ড, সেনসাস, আরও যা যা আছে। বাকি কাজ তো কম্পিউটর করে।”

তারপর কী যে বোঝাল কিছুই বুঝলাম না, শুধু বুঝলাম যে ডেটা থেকে বই বিক্রির প্যাটার্ন ও আগে থেকে নিখুঁতভাবে ধরতে পারে।

আর কী অদ্ভুত ব্যাপার – ও যা যা বলত প্রায় প্রত্যেকটা জিনিস মিলে যেত। একশোবারে ভুল হত হয়ত মেরেকেটে তিনবার। যেদিন যখন যেখানে চাহিদা বাড়বে বা কমবে বলত প্রত্যেকটা অক্ষরে অক্ষরে মিলত। আমরা প্রতিবার ভাবতাম, এটা হতে পারে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওর কথাই ঠিক হত।

মিথ্যে বলব না, শম্বুক যখন ওর পার্ক্স বাড়িয়ে দিয়েছিল, খানিকটা হিংসেই হয়েছিল। যতই হোক্‌ আমি সিনিয়র। কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে বুঝতে পেরেছিলাম যে ও ডেস্কে বসে শম্বুকের জন্য যা করেছে আমার দ্বারা তার ছিটেফোঁটাও হবে না।

“ব্যাপারটা তুমি বুঝছ না,” আমাকে বুঝিয়েছিল একদিন। “দেখো, পুরোটাই ডিমান্ড আর সাপ্লাই, তাই না? যেখানে যখন ডিমান্ড সেখানে তখন সাপ্লাই দিতে না পারলে বিক্রি হবে কীভাবে? আমার একটা অ্যালগরিদম আছে, যেটা দিয়ে আমি বুঝতে পারি কখন কোথায় কীসের ডিমান্ড হতে চলেছে। চেষ্টা করি তিনদিন আগে জানানোর, ব্যাস্‌, আমার কাজ শেষ।”

“আর তাতে কাজ হয়?”

“হচ্ছে তো। হচ্ছে না?”

“কিন্তু এই অ্যালগরিদম সব ক্ষেত্রে খাটবে?”

“না না, আলাদা আলাদা প্যারামিটার তো। ধরো, তোমার একটা মেয়ের প্রতি ক্রাশ আছে। তুমি জানো মোটামুটি সে কখন ক্যান্টিনে আসে। এবার তুমি মোটামুটি সেই সময়টা যাওয়ার চেষ্টা করলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তুমি তাকে দেখতে পাবে। তুমি তোমার প্রেডিকশনে না বুঝেই ডেটা ব্যবহার করছ, তাই না? এবার যত বেশি ডেটা পাবে তুমি ক্রমশঃ আরও ভাল প্রেডিক্ট করতে পারবে, হয়ত এক সময় ঘড়ি ধরে মেলাতেও পারবে।”

“এটা সম্ভব?”

“কেন, তুমি কাউকে স্টক করতে চাও?”

*

বাদ সাধলেন অংশুমানবাবু, শম্বুকের ভাইস-প্রেসিডেন্ট। হার্ট অ্যাটাকের পর থেকে শমীক সোম অফিসে আসা বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে অংশুমানবাবুই কোম্পানির সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিলেন।

সমস্যা হল, সুজাতার প্রোমোশন ওখানেই আটকে ছিল। ওর ওপরে তখন শুধু ভিপি, আর সেই পোস্ট আটকে পড়ে ছিলেন অংশুমানবাবু। আর উনিও জানতেন সুজাতা প্রোমোশন চায়।

সেখান থেকেই দু’জনের মধ্যে ঝামেলার সূত্রপাত। বাড়তে বাড়তে চরমে পৌঁছল একদিন। সুজাতা কানপুর থেকে কয়েকটা বই দেরাদুনে সরাতে চেয়েছিল, অংশুমানবাবু সেটা আটকে দেন। দেরাদুনের আউটলেটে এসে নাকি লোকে খোঁজ করে ফিরে যায়।

সেদিন অফিসে সাংঘাতিক অশান্তি হয় দু’জনের মধ্যে। আর তারপর থেকে কথাবার্তা দূরে থাক, একেবারে দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ। ঐ, মিটিঙে যেটুকু।

আর তখন থেকেই কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায় সুজাতা। কাজে ফাঁকি দিত না ঠিকই, কিন্তু দুপুরের পর বোধহয় মনঃসংযোগে অসুবিধে হত। বিকেলের দিকে কখনও কখনও ডেস্ক ছেড়ে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে থাকত রাস্তার দিকে, হাতে নোটবুক। ফিরে এসে আবার কোড লিখতে বসত। আগে আগে পাঁচটার মধ্যে বেরিয়ে যেত, কিন্তু এখন ক্রমশঃ দেরি করতে শুরু করল।

আর অংশুমানবাবু যখন উঠে দাঁড়াতেন বেরোনোর জন্য (আগেই বলেছি, ঠিক পাঁচটা সাতাশে) তখন দেখার মত ব্যাপার হত। নোটবুক হাতে সোজা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত সুজাতা, যাতে মুখ দেখতে না হয়। অন্ততঃ দশ মিনিট না কাটিয়ে সিটে ফিরত না।

কয়েকদিন পর ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে উঠেছিল। তারপর অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।

*

তাই সেদিন যখন সুজাতা অংশুমানবাবুর ডেস্কে গিয়ে কথা বলল, খানিকটা অবাকই হয়েছিলাম। অশান্তি হয়নি। দুজনেরই আড়ষ্টতা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, তবে যা যা বলার মনে হয় সুজাতা গুছিয়ে বলতে পেরেছিল।

আমরা তটস্থ হয়ে বসে ছিলাম। ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলাম বারবার, কারণ পাঁচটা চুয়াল্লিশ ফসকালে অংশুমানবাবুর মেজাজ গরম অনিবার্য। তিন মিনিট সাতান্ন সেকেন্ড, আগেই বলেছি।

নিয়তি। ঐটুকু দেরি না হলে হয়ত অংশুমান দাশগুপ্তর অ্যাক্সিডেন্টটা হত না।

আর সেটা না হলে সুজাতাও আজ শম্বুকের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হত না।

যতই হোক, কপালের লিখন।

No comments:

Post a Comment