BANNER CREDITS: RITUPARNA CHATTERJEE
A woman with the potential to make it big. It is not that she cannot: she simply will not.
PHOTO CREDITS: ANIESHA BRAHMA
The closest anyone has come to being an adopted daughter.

Monday, September 26, 2011

দাদা

আজ বেশ গরম। একবার জলে না নামলেই নয়।

তেল–টেল মেখে জলে নামতে গিয়ে খোকন লক্ষ করল যে নদীর ওপারে অনেক ছেলেমেয়ের ভিড়। স্বাভাবিক। আজ যা গরম, ইস্কুল শেষ হতেই সব জলে নেমে পড়েছে।

ক্ষীরনদীর জল ঠিক আর পাঁচটা নদীর মত নয়। বেশ পরিষ্কার, এমনকি হয়ত স্বচ্ছও বলা চলে। এপারে নানান্‌ পাখি, কাক চড়াই শালিক পায়রা কাদাখোঁচা, ডেকে উঠছে মাঝেমধ্যে।

এই ভরা জল গ্রীষ্মেও বেশ ঠাণ্ডা। আরামে চোখ বুজে এল খোকনের। ঘাট থেকে কয়েক পা এগিয়ে সে গা এলিয়ে দিল। কয়েকটা ডুব, তারপর জলে গলা অবধি ডুবিয়ে ভেসে রইল।

কী হল?

সবাই এত চুপ কেন হঠাৎ?

খোকন চোখ খুলল। ওপারে, অনেকদূরে ছেলেমেয়েগুলো খেলছে। কিন্তু এপারে? ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, বাকি পাখিগুলো বেপাত্তা। শুধু কয়েকটা পায়রা।

খোকন পায়রা চেনে। এগুলো লক্কার মত বড়, সাদা নয়, এদের ঠোঁটও গোলাপি নয়। এগুলো ধূসর, চোখের পাশে সাদা বৃত্ত, সাইজেও ছোট। মাথায় ঝুঁটিও আছে। এগুলোকে বলে নোটন।

শুধু কয়েকটা নোটন পায়রা। সেগুলো উড়তে শুরু করল। নদীর দিকে।

পায়রা কি নদীর দিকে ওড়ে? ওরা থাকে তো ডাঙায়, হঠাৎ এদিকে আসবে কেন?

ওদের পায়েই বা কী বাঁধা? চিঠি? চিঠি এত বড় হয়? আর সবাই নদীতে আসছে কেন? খোকনের দিকেই আসছে কেন?

এটা কী তাহলে পায়রাদের একটা বাহিনী? খোকনকে আক্রমণ করছে ওরা? কিন্তু কেন?

খোকন কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরেকটা কেউ জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। খোকনের পাশে এসে দাঁড়িয়ে একবার বুক ভরে শ্বাস নিল, তারপর দাঁত থেকে জিনিসটা বের করল।

একটা কলম।

খোকন কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটা পায়রাগুলোর দিকে কলমটা ছুঁড়ে মারল। নিমেষের মধ্যে একটা সাংঘাতিক বিস্ফোরণ ঘটল। পায়রাগুলো নিশ্চিহ্ন হল ঠিকই, কিন্তু কিছুর একটা টুকরো উড়ে এসে খোকনের কপালে লাগল।

“কী হল?

“উঃ! বড্ড লেগেছে!”

*

“খেয়ে নে খোকন।”

“না, আগে পুরোটা বলুন।”

“আপনি-আপনি করতে বারণ করলাম না।”

“ঠিক আছে, বেশ। পুরোটা বলো।”

“অবাধ্যতা করিস্‌না। আমি এইজন্য পায়রাগুলোকে মারলাম? এইজন্য তোকে বাঁচালাম? দুধ–ভাত মেখে রেখেছি, খেয়ে নে। কাকে খেয়ে যাবে নয়তো।”

“বেশ, খাচ্ছি, কিন্তু ততক্ষণ বলো, তুমি কে? কেন বাঁচালে?

“বললাম তো, আপাততঃ ধরে নে, আমি তোর দাদা।”

“ধরে নে মানেটা কী? মানছি যে তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ। তার বদলে যদি চাও, তোমাকে দাদা বলে ডাকতে পারি। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে সত্যিই তুমি আমার দাদা!”

“ধরে নে তাইই।”

খোকন একটু অবাক হলেও খাওয়া বন্ধ করল না।

শুধু দুধ–ভাত নয়। কলা, গুড়, আরো নানারকম দিয়ে মাখা, প্রায় পায়েসই। আশ্চর্য ব্যাপার, ‘দাদা’ একবার বারণ করার পর কাকগুলো আর এমুখো হচ্ছেনা। একটু আগেও দেখেছে, গোটাদশেক কাঠবেড়ালি ‘দাদা’র কথা শুনে পেয়ারা, গুড়–মুড়ি, দুধ–ভাত, বাতাবিলেবু, লাউ, মানে রাজ্যের খাবার খেয়ে গেছে। এইসব দেখে তার ধারণা হয়েছে ‘দাদা’র কথা বোধহয় এইসব জন্তুজানোয়ারেরা শোনেটোনে।

“কলমটায় কী ছিল, দাদা?

“ওঃ, ওটা ছোট্ট হাতবোমা, কিন্তু বেশ শক্তিশালী। পায়রাগুলোর পায়ে নানান্‌ অস্ত্র বাঁধা ছিল, সবকটাকে না মারলে তুই যেতিস্‌।”

“কিন্তু কারা আমাকে মারতে চায়? আর তুমিই বা অত ঝুঁকি নিয়ে আমাকে বাঁচালে কেন?

‘দাদা’ বেশ অন্যমনস্ক হয়ে গুনগুন করে একটা বেসুরো গান গাইতে লাগল, আর শোলা দিয়ে একটা অস্বাভাবিক ছোট্ট কী বানাতে লাগল।

“উত্তর দিচ্ছ না কেন? আর এটাই বা কী বানাচ্ছ?

“ম্‌ম্‌ম্‌, এটা? আজ কলাবাদুড়ের বিয়ে, টোপর বানাতে হবে একটা।”

খোকন ঠিক শুনল তো?

“কী বললে?

“ঠিকই শুনেছিস্‌। আজকাল বউয়েরা খুশি হয় না চট্‌ করে, তাদের দিব্যি ভালোমন্দ–জ্ঞান আছে। এই আমাকেই দেখ্‌ না: আমার বউ গাছ এত ভালোবাসে, আতা আর ডালিম গাছ লাগালাম, তাতেও বউ ডাকলে সাড়া দেয় না। এখন তো আতাগাছভর্তি টিয়াপাখি, ডালিম গাছেও এতবড় মৌচাক, কিন্তু বাড়ির অবস্থা যে-কে-সেই।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদা টোপর বানাতে লাগল।

“তুমি আমাকে বাঁচালে কেন?

“আমি তোকে আগেও বাঁচিয়েছি, মনে নেই?

“কবে?

“তুই একবার মাছ ধরতে গেছিলি, মনে আছে? এই ক্ষীরনদীতেই?

“সেই যেবারে চিল...?

“হ্যাঁ। খুব সম্ভবতঃ তুই আরেকটু থাকলে তোকে জলে ফেলত ওরা। আর তারপর ডুবিয়ে মারত। মাছটা সাধারণ মাছ নয়, সম্ভবতঃ রোবট, আর ছিপের নিচেও চুম্বক লাগানো ছিল। তোকে মারার পুরো প্ল্যান রেডি ছিল।”

“তারপর?”

“তারপর আর কী? আমার চিল মাছ নিয়ে উড়ে বেরিয়ে গেল, কিন্তু তাতেও বিপদ কাটেনি। কোলাব্যাংকে বলেছিলাম তোর ছিপটা কেড়ে নিতে, কিন্তু সে তখন তাঁতির বাড়ি বসে সোনার সঙ্গে গলা সাধতে ব্যস্ত, পাজামার নাড়া বাঁধারও সময় হয়নি। যাক্‌গে, শেষ মুহূর্তে খেয়াল হওয়ায় গিয়ে কেড়ে নিয়েছিল বলে বেঁচেছিলি, নয়ত ঐ চুম্বক তোকে টেনে নামাত।”

“তুমি...?

“আরও আছে। মনে আছে, ক্ষীরনদী পার হচ্ছিলি একা? মাঝি অসুস্থ হয়ে পড়ল হঠাৎ করে?

“হ্যাঁ, বেশ ভয় পেয়ে গেছিলাম। আমি সাঁতার জানলেও কখনও নৌকো চালাইনি, আর সেদিন বেশ ঝড়বৃষ্টি ছিল। কোত্থেকে সাতটা কাক এসে দাঁড় বেয়ে আমাকে পৌঁছে দিল।”

‘দাদা’ মৃদু হাসল।

“আজকেও আমি নিজে যেতাম না। কিন্তু বাকি পাখিগুলো ভয় পেয়ে গেল যে!”

আসল প্রশ্নের উত্তর কিন্তু তুমি এখনও দাওনি। কেন বাঁচাও আমাকে তুমি?

“কারণ আমি জানি ছোটবেলায় তোর ওপর দিয়ে কী গেছে। একটার পর একটা...”

“তুমি জানো? কিন্তু...

“হ্যাঁ রে। প্রত্যেকটা। আর তুই বাড়ি থেকে কেন কীভাবে পালিয়েছিলি, তাও জানি।”

“আমি পালাইনি দাদা। খুব কষ্ট হয়েছিল, তাই জঙ্গলে চলে গেছিলাম। আমি থাকতে চাইনি। কারণ আমি জানতাম, কে করছে। শেষে বুঝে গেছিলাম।”

“তুই জানিস্‌?

“হ্যাঁ। আমি আর ছোড়দা যখন ব্যাং ধরতে যাই, তখন ছোড়দাকে সাপে কামড়ায়। কিন্তু সাপটা ঢোঁড়া ছিল, মরার কথাই নয় ছোড়দার। বিষ তো মেশানো হয়েছে তার পরে।”

“কে, তুই জানিস্‌?

“দাদা, আমার বাবা ডাক্তার, জানো তুমি? শহরের সবথেকে বড় ডাক্তার? আর আমরা তো সৎ ছেলে, মার আগের পক্ষের ছেলে। আমাদের মারতে সৎ বাবার হাত কাঁপবে কেন?

“তুই এটা বুঝতে পেরেছিস্‌?

“আলবাৎ। কিন্তু আমি পালানোর পর আবার মারার চেষ্টা কে করল? বাবা কি জেনে গেছিল?

“অনেকদিন। আর তারপর থেকেই নানাভাবে মারতে চাইছে, কিন্তু প্রতিবার আমি ভেস্তে দিয়েছি। বাকি ভাইদের জন্য পারিনি। কাঠ কাটতে গিয়ে মামুলি চোট থেকে ধনুষ্টঙ্কার, ভাত খেতে বসে ফুড পয়জনিং, গাছ থেকে পড়ে বা নাচতে গিয়ে পিছলে পড়ে হাড় ভেঙে জ্ঞান না ফেরা, এর প্রত্যেকটার জন্য যে বাবা দায়ী, সেটা আজ বুঝি।

“আর বাকিরা?”

“বাকিরা?” হাসল দাদা। “দুজন জলে ডুবে, আর একজন বাঘের পেটে। মনে করে দেখ্‌, তিনবারই বাবা ওদের পাঠিয়েছিল, তাই না?

কিন্তু বড়দা? তাকেও কি ভাড়াটে গুণ্ডা –”

মুচকি হাসি।

“তুমি? তুমিই?

আবার মুচকি হাসি।

“বড়দা! সত্যিই তুমি?খোকন বোধহয় কেঁদেই ফেলবে এবার: “এত বছর কোথায় ছিলে?

“আমি খানিকটা আগে থাকতে আঁচ পেয়েছিলাম রে। একটা ট্রেন ধরে বনগাঁ চলে গেছিলাম। ওখানে মাসি আর পিসির খই আর মোয়ার কারবার। কদিন ওখানেই ছিলাম। তবে ওরা যা কিপ্‌টে, ব্যবসা থাকলে কী হবে, বিশেষ খেতে-টেতে দিত না। তারপর একটা ট্রেন ধরে চলে গেলাম কালনা।”

“কালনা?

“হ্যাঁ। ছিলাম কয়েকবছর। পাঁচজন মহিলা, বিয়ে-থা হয়নি, আমাকে নিজের ছেলের মত বড় করল।”

“কারা এরা?

দাদার মুখ একটু লালচে হল। “ওদের এক দিদি আছে, তার নাতবৌ আমাদের পাড়ায় থাকত – মনে আছে? ক্ষান্তমণি।”

খোকনের হাসি পেলেও চুপ করে রইল। ক্ষান্তদির প্রতি দাদার দুর্বলতার কথা পাড়ায় সবাই জানত। কিন্তু এখন হাসার সময় নয়।

“বুড়িগুলো একটু অদ্ভুত। সবই উল্টোপাল্টা করত। কিন্তু আমাকে ভালোবাসত খুব। ওরাই আমাকে নিজের ছেলের মত দেখত বলতে পারিস্‌। তোর খবর অবিশ্যি ক্ষান্তই দিত আমাকে। আমি জানতাম তুই বেঁচে গেছিস্‌। তাই কিছুদিন পরেই তোকে খুঁজে বের করলাম, তারপর তোকে বাঁচাবার চেষ্টা করলাম বারবার।”

“তুমি ফেরার চেষ্টা করনি?”

“প্রথম প্রথম ইচ্ছে করত না। কেন ফিরব? কার কাছেই বা ফিরব? ক্ষান্ত বলেছিল যে সবাই জানে আমি মরে গেছি, সুতরাং লুকোনোটাই বুদ্ধিমানের কাজ হত। কিন্তু তারপর জানতে পারলাম তোর ওপর হামলা চলছে।”

আতাগাছ থেকে টিয়াপাখিটা সমানে “খোকন” “খোকন” করে যাচ্ছে। বাড়ির খড়ের চালে একটা ফিঙে নাচছে। একটা উদ্‌বেড়াল কোত্থেকে এসে ছড়িয়ে রাখা খুদ খাচ্ছে।

খোকন বুঝল, ওর চোখ ক্রমশঃ জলে ভিজে আসছে। অন্যদিকে তাকাল সে।

*

“দাদা, বাবা এটা কেন করল?

“টাকার জন্য। মা মারা যাওয়ার পর মার সম্পত্তির এগারোভাগ হত। আমাদের সরিয়ে এখন সবকিছুর মালিক হয়ে বসেছে। ব্যাপারটা মোটামুটি এইই জানতাম। কিন্তু এখন...”

“এখন?”

“এখন বুঝি ব্যাপারটা অন্যরকম। এই যে, আবার বিয়ে করল...?”

“বিয়ে? আবার?

“হ্যাঁ। বাচ্চাও হবে।”

“কাকে বিয়ে করেছে?

“তুই নাম শুনিস্‌নি হয়ত। আমাদের গ্রামের নয়। কিন্তু খুব, খুব মারাত্মক মহিলা। খুনী।”

“খুনী?

“আমার ধারণা বাবার সঙ্গে মহিলার সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই। আমাদের সরানোর বুদ্ধি এই মহিলারই। হারাধন ডাক্তার প্রথম প্রথম আমাদের ভালোই বাসত, মনে করে দেখ্‌। আর এত বছর পর খুঁজে পেয়ে হয়ত খুশিই হত।”

“হত?

“মহিলার বাচ্চা হবে, আমি জানতে পেরেছি। এও জানতে পেরেছি যে এই বাচ্চাটা অন্যের। এটা জানতে পারলে বাবা ওকে আর আস্ত রাখত না।”

“রাখত না মানে?”

“আমার কাছে যা খবর আছে, তাতে ও বাবাকে কাল রাত্রে খুন করেছে। আর তার পরেই তোর ওপর আক্রমণ।”

টিয়াপাখিটা থেমে গেল হঠাৎ। ঘন জঙ্গলের মধ্যে বাড়ি, তাই চট্‌ করে বোঝা শক্ত, কে, কিন্ত পায়ের আওয়াজ স্পষ্ট। আর সেটা এগোচ্ছে। আরো কাছে।

কীসের আওয়াজ? স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে দুপেয়ে জীব, কিন্তু নিশ্চিতভাবে মানুষ নয়।

গাছের ফাঁক থেকে একটা কিম্ভূতকিমাকার মূর্তি বেরিয়ে এল। সাধারণ মানুষের থেকে উচ্চতায় অনেক কম। নির্মম গোল দুটো চোখ। হাঁটার মধ্যে একটা অদ্ভুত ছন্দ আছে। আর সবথেকে অদ্ভুত ব্যাপার, মাথার ওপরে রক্তের দাগ শুকিয়ে যাওয়া, সাংঘাতিক ধারালো দুটো শিং।

“খোকন, এঁর কথাই বলছিলাম। এঁর শিঙে লেগে থাকা রক্তটা বোধহয় বাবার। আসুন, টিম্‌টিম্‌ দেবী।”

*

“তোরা সবই জানিস্‌, তাই না?”

“হ্যাঁ। আশাকরি বুঝতে পারছেন যে আমিই সেই হারিয়ে যাওয়া বড় ছেলে। আর আমার ভাইয়ের কথা তো আপনি জানেনই। সুতরাং এবার আপনি সম্পত্তির মোটে তিনভাগের একভাগ পাবেন। বাকিটা পাব আমরা।”

“তার জন্য তোদের বেঁচে থাকতে হবে তো!” মাথা নিচু করে অভ্রান্ত লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল হাট্টিমা। সে পেশাদার খুনি। খোকন শেষ মুহূর্তে সরে যাওয়ায় হাতে ঘষে গেল হাট্টিমার শিং। তাতেই গলগল করে রক্ত বেরোতে লাগল।

শিকার ফস্কে যাওয়ায় হাট্টিমা অধৈর্য হয়ে আবার ঝাঁপাল। কিন্তু দাদা প্রস্তুত ছিল, অনায়াসে পাশ কাটাল। আবার ঝাঁপাল, আর এবার দাদার কোমরে বেশ জোরে লাগল।

খোকন ঝাঁপিয়ে পড়ল, ধাক্কা দিতে চেষ্টা করল, কিন্তু হাট্টিমা অসম্ভব ক্ষিপ্র। নিমেষের মধ্যে ঘুরে সে শিং বসাল খোকনের ডান ঊরুতে। দুজনেরই যদিও এখনও তেমন গুরুতর চোট লাগেনি, এইরম আর কয়েকটা হলে বাঁচানো শক্ত হবে।

হাট্টিমার মধ্যে অবশ্য ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই। স্পষ্ট বোঝা যায় সে এইধরনের লড়াইয়ে অভ্যস্ত, দুজন নিরস্ত্র মানুষ তার কাছে কোনো ব্যাপারই নয়।

আবার হাট্টিমা ঝাঁপাল। খোকনের বাঁ ঊরুতে আঘাত করে ফালাফালা করে দিল। খোকনের উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাটুকুও রইল না। দাদা কোমরে হাত চাপা দিয়ে তখনও শুয়ে।

দাদা এতবার বাঁচিয়েছে তাকে। প্রতিদান দিতে পারল না খোকন।

কিন্তু এটা কী হচ্ছে?

হাট্টিমা টিম্‌টিম্‌ মাটিতে পড়ল – হঠাৎই, আর পেট চেপে ধরে চিৎকার করতে লাগল। অদ্ভুত একটা শ্বাসকষ্ট, পাগলের মত ছট্‌ফটানি, একটা আর্তনাদ...

দুভাই কোনোমতে গড়িয়ে গড়িয়ে পৌঁছল হাট্টিমার কাছে। ততক্ষণে সব শেষ।

তারাও জ্ঞান হারাল।

*

খোকনের জ্ঞান ফিরল হাসপাতালে। পাশের বেডে দাদা।

“ঠিক আছিস্‌?

খোকন হাসল।

“যাক্‌, যা হওয়ার হয়ে গেছে। হাট্টিমা বাঁচেনি, জানিস্‌ তো।”

চুপ করে রইল খোকন।

“কীভাবে মরল জানতে চাস্‌ তো? খুব সহজ। বলেছিলাম না ওর বাচ্চা হবে? আসলে ভুলে গেছিলাম, মানুষের মত ওর বাচ্চা হয়না ওদের। ওরা ডিম পাড়ে। আর সেটা মাঠেই পাড়ে। ডিম পাড়ার সময় চারপাশ থেকে হাওয়া না দিলে আর মাথার ওপর সূর্য না থাকলে ওরা অসুস্থ হয়ে পড়ে।

“ঠিক তাইই হল। আমাদের বরাত ভাল যে ওর প্রেগনেন্সির একদম শেষ স্টেজ ছিল। আমার বাড়িটা ঘন জঙ্গলের মধ্যে, তার ওপর সন্ধেবেলা। ও না পেল চারপাশ থেকে হাওয়া, আর না মাথার ওপর রোদ্দুর। আর খুনি হোক আর যাই হোক, মারপিট করতে গেলে একটা ধকল যাবে না?”

খোকন আবার হাসল। এবার সে নিরাপদ। সম্পূর্ণভাবে। ইস্‌স্‌, বাকি দাদারা যদি থাকত। যাক্‌, যা আছে, তাই বা কজনের থাকে?

এক মহিলা ঢুকলেন রিপোর্ট হাতে। নির্ঘাত বৌদি। আর তখনই – অন্য দরজা দিয়ে ক্ষান্তদি।

খোকন চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। ঘুমোনোর ভান করে।

Friday, September 23, 2011

Panthera tigris

The great man had an eye issue or whatever, so he had to cover up the bad eye to turn into Sunil Pirate Gavaskar for a day. The problem was, he couldn't do his basics, like pick up his toothbrush or grasp a glass of water.

Now, imagine that you have lost an eye permanently at the age of twenty. Then, you travel to the West Indies, the land of fast bowling, the very next year - an age when we run to tutorials for suggestions and drool over the most flat-chested of women. At Barbados, a place known for ferocious fast bowlers (Hall, Marshall and Garner are a few examples), Griffith, the mean Charlie Griffith chucks one and fells your captain. And you're asked to lead your country, not for an interim period, but on a permanent basis.

You do that. And till these two rogues from East India came along, the clash for the greatest captain ever always remained between him and Wadekar; there was no third participant, not even Kapil Dev or SMG.

Tiger's numbers don't really suggest he was outstanding. Indeed, 2,793 runs at 35 doesn't seem too extraordinary. I agree that he had played with one eye, but even then, 35 doesn't seem good enough to get yourself a place in the XI, isn't it?

Let's check how other Indians did in the 1960s, then, before he took his rather unusual sabbatical from test cricket. Borde tops the chart with 2,562 at 37.13, and Pataudi comes a very close second with 2,552 at 36.98. Jaisimha, Engineer, Manjrekar, Wadekar, Sardesai and Umrigar have actually scored less in the 1960s. Just wonder what he would have done without his physical drawback.

His greatest hurrah, though, came in 1968 at MCG. He came in at 25/5, pulled a hamstring, batted with a runner and scored 75, the innings of his life. He backed it up with 85 in the second innings, but that seemed irrelevant after the 75. Almost anything would have.

But that's sheer numbers. What the scorebooks craftily overlook is the fact that before Pataudi, no other Indian captain had given the nation a belief that we're as good a side as any other. We can take on any side in the world; we may lose, but we're not going to give up without a fight.

He knew he wouldn't have a fast bowling attack as potent as his contemporaries. So he chose to fall back on spin, and promote all-rounders: this led to spectacles Indian cricket has almost never witnessed in the past or future: four spinners or four all-rounders playing simultaneously, match after match. His resources were limited. But he made sure he made the most of whatever he had at his disposal.

And then, when all seemed lost in The Summer of 42, after the selectors had sacked Wadekar and The Bat in Indore was tarnished, Pataudi made a comeback. To counter Roberts, Holder and Julien (and Gibbs) the best option he had was Madan Lal, who used to bowl slightly faster than my grandfather walks these days. Which is saying something, since the latter is, alas, dead for ten years.

To add to that, Gavaskar remained injured for three of the five tests. India were down 0-2, and then, thanks to Viswanath's brilliance, managed to set up okayish targets for Lloyd's men (that included Greenidge, Fredericks, Kallicharran, Richards and Lloyd himself) during both the next two tests.

And then, despite persistent boos from the crowd after being hit, Chandra was persisted with at Calcutta and Prasanna at Madras. And we won twice to come back from nowhere. True, we lost the final test, but not without a fight, and the series was possibly the greatest ever played on Indian soil till a certain VVS turned things around at the same two grounds over a quarter of a century later.

Oh, did I also mention that he was an existing nawab, and married one of the bombshell filmstars of the era?

We have a Little Master. A Haryana Hurricane. A Master Blaster. A Wall. A Whatever of Najafgarh. A Very Very Special person. Even a Maharaj and a Jumbo. But only one Tiger. Because the others played king-size. Tigers live that way. You see, not many captains prowled in the covers instead of yawning at first slip or mid-off.


Sunday, September 18, 2011

চোট

(এটা আনন্দবাজারের একটা প্রতিযোগিতার জন্য লেখা। প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী এখানে পাওয়া যাবে। আমি নিশ্চিত যে এই অদ্ভুত লেখা আদৌ ছাপা হবে না, তাই নির্দ্বিধায় এখানে লিখে ফেললাম।)
__________________________________________________________


ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল ঋষি। মেয়েটা একেবারে সামনে। ক্রসিং-এর লাল লাইটে গান বাজছে "যদি তারে নাই চিনি গো..."

ঋষির দোষ নয়। সিগনাল পড়ে গেছে, মেয়েটা অনায়াসে একদম মোড় দিয়ে রাস্তা পেরোতে পারত। কিন্তু সবাই যদি তাইই করত, তাহলে ট্র্যাফিকের অবস্থা আজ এত শোচনীয় হত না। আসলে রাস্তা যে গাড়ির নিজস্ব অঞ্চল, তা বেশিরভাগ পথচারীরই নিরেট মাথায় ঢোকে না।

লোক জড় হয়ে গেল নিমেষের মধ্যে। ঋষি কিছুতেই বোঝে না, একটা সামান্য দুর্ঘটনা হলেই এত লোক এসে জোটে কীভাবে? অথচ খবরের কাগজে প্রায়ই বেরোয়, সত্যিকারের বড় কিছু হলে মৃতদেহ পড়ে থাকে, লোকে  পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আর এইর'ম ফালতু কেসে?

ঋষি নামল গাড়ি থেকে। বেশি দেরি হলে হয়ত এরাই আগুন-ফাগুন জ্বালিয়ে দেবে। নতুন গাড়ি, তার থেকে নেমে দেখাই ভাল!

মেয়েটার ধাক্কা লাগেনি, তবে মুখ দেখে মনে হয় বেশ ভয় পেয়েছে। "বড়লোকের ছেলের হাতে স্টিয়ারিং" গোছের মন্তব্য ভেসে এল দুয়েকটা।

"আপনি উঠতে পারবেন?"

মেয়েটা মাথা নাড়াল, তারপর নিজেই উঠে দাঁড়াল। সাধারণ, সাদাসিধে, নেহাৎই ঘরোয়া ধরনের দেখতে। পরনে একটা সাদামাটা সালোয়ার-কামিজ। একটা আলগা শ্রী আছে।

"আপনাকে কোথাও পৌঁছে দেব?"

"না না, আমি যেতে পারব। আসলে ট্যাক্সি ধরতেই যাচ্ছিলাম। তারপর..."

ঋষির এবার একটু অপরাধবোধই হল। "দেখুন, আমি ল্যান্সডাউনের দিকে যাচ্ছি, আপনাকে নামিয়ে দেব কোথাও?"

মেয়েটা বেশ লাজুক। অথবা বোধহয় পুরো ব্যাপারটায় একটু ঘাবড়েছে। ইতস্ততঃ করতে লাগল তাইই হয়ত।

"চলুন। আমার কোনো অসুবিধে হবে না।"

"আমি যোধপুর পার্কে থাকি। আপনাকে পুরোটা যেতে হবে না, আপনি ল্যান্সডাউনে নামিয়ে দেবেন, আমি ওখান থেকে চলে যেতে পারব।"

ঋষি হেসে ফেলল। ভিড় পাতলা হতে শুরু করেছে এদিকে।

"বেশ, তাইই হবে। উঠুন এবার।"

***

শ্যামবাজার থেকে ল্যান্সডাউন অনেকটা রাস্তা। তার ওপর মিছিল-টিছিল আছে বোধহয় আজ, একটু বেশিই দেরি হচ্ছিল।

অন্যান্য দিন হলে ঋষি বিরক্তই হত। কিন্তু আজ শর্মিষ্ঠা থাকায় ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে গেছে। মেয়েটা ডাক্তারির ছাত্র, ফাইনাল ইয়ার, খুব ইচ্ছে সার্জেন হবার। খুব ভালো হাত নাকি, প্রোফেসররা বলেন। এইবছর পাশ করবে।

ঋষি এমনিতে বেশ শান্ত, সংযত। মেয়েরা ছোটখাট জামাকাপড় পরলে তাকায়, রাতের দিকে গোলমেলে ওয়েবসাইটে ঘোরাফেরা করে, কিন্তু সেটা পঁচিশ বছরের ছেলেদের পক্ষে স্বাভাবিক ব্যাপার। সেই অর্থে কোনো অ্যাফেয়র হয়নি, আর স্কুলে দুয়েকটা টুকটাক বাদ দিলে কোনো মেয়ের প্রতি সেইর'ম শারীরিক আকর্ষণও বোধ করেনি। বরং সে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ চুটিয়ে আড্ডা দিতে।

শর্মিষ্ঠা মেয়েটা অন্যরকম। আপাতঃদৃষ্টিতে বেশ সাধাসিধে মনে হয়, কিন্তু খানিকক্ষণ কথা বলার পর বোঝা যায়, ওর গলার স্বরে, হাসিতে, তাকানোয় এমন কিছু আছে, যা শুধু আকর্ষণ করে তাইই নয়, মন অশ্লীল করে তোলে। অকারণে ছুঁতে ইচ্ছে করছে বারবার, এইটুকু আলাপেই।

***

একা থাকে ঋষি। বাবা-মা দুর্গাপুরে, সে চাকরি পাওয়ার পর থেকে একের পর এক সম্বন্ধ দেখেই চলেছেন তাঁরা। ঋষিও বদ্ধপরিকর, জানিয়ে দিয়েছে সে আপাততঃ বিয়েতে ইন্টারেস্টেড নয়।

কিন্তু শর্মিষ্ঠা? শর্মিষ্ঠা যদি রাজি হয়, তাহলেও কি সে বিয়ে করবে না? ও সাবধানে তাকাল একবার। গাড়ি জ্যামে আটকে। শর্মিষ্ঠা তাকিয়ে, সামনের দিকে।

চিবুক থেকে ওড়না। অদ্ভুত একটা সর্পিল কার্ভ, গলার; শিউরে উঠল ঋষি। মেয়েটার কালো রঙের মধ্যে একটা আদিম, বন্য আকর্ষণ আছে। বিয়ে হলে এই গলায় ঠোঁট ডুবিয়ে...

সব মেয়ের গলা কী এইর'মই হয়?

গলা শুকিয়ে গেছে ঋষির। জলের বোতলটাও খালি।

"আপনার কাছে জল আছে?"

"হ্যাঁ।"

খেতে গিয়ে ঋষি ফেলল। জামা ভিজল খানিকটা। কিন্তু তার সঙ্গে যোগ হল শর্মিষ্ঠার হাসি। সহজ, সরল হাসি, কিন্তু কিছু একটা আছে যাতে ঋষির শিরায় ধমনীতে আগুন ধরে গেল। সে অনুভব করল, কান, ঘাড় বেশ গরম হয়ে গেছে...

***

ল্যান্সডাউন এল।

"আপনাকে পৌঁছে দিই?"

চুপ।

ঋষিও চুপ।

গাড়িতে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা।

"আপনি আসবেন একটু, আমার বাড়ি?"

শর্মিষ্ঠা চোখ তুলে তাকাল। চোখে আগুন। রাগ? ঋষি জানেনা। জানতে চায়ওনা।

"আপনি একা থাকেন বলেছিলেন না?"

"আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না?"

শর্মিষ্ঠা সামনের দিকে তাকাল। তারপর আবার ঋষির দিকে। "আমি বাড়িতে একটা ফোন করি, দাঁড়ান। বেশিক্ষণ বসব না কিন্তু।"

ঋষি হাসতে চাইলেও তার শরীর তাকে হাসতে দিল না। ফিজিওলজিতে হয়ত এর প্রকৃত কারণ লেখা আছে কোথাও। ঋষি জানেনা।

ঋষি আর কিছুই জানেনা। গাড়ি থেকে নেমে চশমার কাঁচ মুছে চোখে পড়ল, শর্মিষ্ঠার সাদা কামিজে ঘামের বৃত্ত।

কখন দরজা খুলল, কখন আলো জ্বালল, শর্মিষ্ঠা কখন বাথরুমে গেল, কখন খাবার বের করল, ঋষির কিচ্ছু মনে নেই। শুধু গলা। হাসি। ঘামের ভিজে দাগ।

ঋষি কীর'ম নেশাগ্রস্ত। আলমারি খুলে স্কচ বের করল। শর্মিষ্ঠা বলল ও খায় না। এক পেগ। দুই। তিন। চার।

যুদ্ধ। শালীনতা আর শরীরের।

আরেক পেগ।

অদ্ভুত উন্মাদনা। উন্মত্ততা। সৃষ্টির শুরু থেকেই কী পুরুষ নারীকে এইভাবে চেয়ে এসেছে?

"আমাকে এবার যেতে হবে।"

ঋষি উঠে দাঁড়াল। জ্বরের বিকারগ্রস্ত রোগীর মত কিছু একটা বলতে চেষ্টা করল, পারল না। টলে গেল। শর্মিষ্ঠা কোনোমতে ধরল ঋষিকে, বেডরুমে বিছানা অবধি নিয়ে গেল। ঋষির অধৈর্য, অতৃপ্ত আঙুল, ঠোঁট খুঁজতে চেষ্টা করল শর্মিষ্ঠাকে। আচ্ছন্ন মস্তিষ্ক জানান দিল, একটা একটা করে জামার বোতাম খুলে যাচ্ছে।

শরীর। শরীর।

তারপর আর কিছু মনে নেই।

***

কয়েক মাইল দূরে সেলফোনের ক্ষীণ আওয়াজ। কেটে গেল।

আবার।

আবার।

এবার যেন জোরে।

চোখের পাতা বড্ড ভারি।

ভীষণ শীত।

শরীর অবশ।

শর্মিষ্ঠা...

আবার ফোন।

আবার।

ধরার শক্তি নেই।

***

"ফোন ধরছে না?"

"নাঃ। তুই কর্‌ তো কয়েকবার।"

"আরে, আমি এসব বলতে-টলতে পারিনা।"

"ধুর, এ আবার পারার কি আছে? প্রথমে বলবি, প্যানিক না করতে, কারণ বাথটবে শোয়ানো আছে, আর যে পরিমাণে বরফ দেওয়া আছে, কয়েকঘন্টা সেফ। এমার্জেন্সি নম্বরগুলো দিবি, বেলভিউ উডল্যান্ডস সব, আর বলতে বলবি, দুটো কিডনিই বের করে নেওয়া হয়েছে, যেন এখনই অ্যাম্বুলেন্স পাঠায়। তুই ট্রাই করতে থাক, আমি বাথরুম থেকে আসি একটু।"

Monday, September 5, 2011

নুন

(এটা আনন্দবাজারের একটা প্রতিযোগিতার জন্য লেখা। প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী এখানে পাওয়া যাবে। আমি নিশ্চিত যে এই অদ্ভুত লেখা আদৌ ছাপা হবে না, তাই নির্দ্বিধায় এখানে লিখে ফেললাম।)
__________________________________________________________
মুদিখানার হরেন সাহা বলল, "নুন নাই গো, কাল রাতে পলাশদা-রা পুরো বস্তা তুলে নিয়ে গেছে। তবে বলল, আর লাগবে না। কাল এস, পেয়ে যাবে।"

সুরজিৎ বেশ চমকে গেল। আবার? আবার নুন নিয়ে গেছে? কিসে লাগে এত নুন? এই সপ্তাহে ওরা রোজ একবস্তা করে নুন নিয়ে গেছে - কিসের কারবার পলাশকাকুদের?

কেমিস্ট্রির ছাত্র সে। তার সম্যক ধারণা আছে, নুন কী কী কাজে লাগতে পারে। তার একটাও বক্সীগঞ্জে হচ্ছে বলে তো সে শোনেনি। এই গ্রামে ছোটখাট বাদ দিয়ে তেমন বড় কোনো কারখানা নেই; শুধু টুকটাক চাষবাস আর ডিম-মাংস বেচে সংসারগুলো কোনোমতে চলে।

হিন্দু গ্রাম, তাই নির্দ্বিধায় মুরগির সঙ্গে শুয়োরও কাটা হয়। সেই মাংসর বেশিটাই চলে যায় কলকাতায়, বড় বড় সুপারমার্কেটগুলোয়, হোটেলে: সেখানে খানিকটা নুন-ভিনিগার লাগে বৈকি। কলকাতায় থাকতে সে খেয়েওছে।

পলাশকাকুদের নিজস্ব খোঁয়াড় আছে, ঠাণ্ডাঘরও; সেখানে শুয়োর কেটে নুন মাখিয়ে রাখা হয় বৈকি। কিন্তু এখানে তো অত মাংস পাওয়া যায় না।

তাহলে?

নাঃ, ব্যাপারটার খোঁজ নিতেই হচ্ছে। এমনিতেই লোকটা সুবিধের নয়, নানান্‌ শুনেছে ওর নামে। আর কাল থেকে আর লাগবে না মানে যা করার আজ রাতেই করতে হবে।

***

বাবা-মার ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষা শুধু। পুলিশকে জানাবে ভেবেছিল, কিন্তু কে জানে, ভেতরে কাকে কত টাকা খাইয়ে রেখেছে পলাশকাকুরা? তার থেকে একা যাওয়াই ভালো।

গল্পের গোয়েন্দাদের কাছে কীর'ম বন্দুক-টন্দুক থাকে। ওদের ব্যাপারস্যাপার অনেক ঘ্যাম। যাক্‌গে, একটা টর্চ আর একটা ছাতা নিয়ে সুরজিৎ বেরিয়ে পড়ল। সঙ্গে আরও কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস। কাদা, মশা, আরো নানান্‌, কিন্তু সে একেবারেই অদম্য। মা বলেন, "সুখে থাকতে ভূতে কিলোনো।"

পুকুরপাড় দিয়ে যেতে যেতে একবার মনে হল, ওডোমসটা মাখলে হত। কিন্তু থাক্‌, এখন আর এই কারণে ফিরে যাওয়ার মানেই হয় না। যাওয়া যাক্‌।

আজ কীর'ম একটা শুনশান চারদিকে। স্কুলটা কীর'ম ভূতুড়ে বাড়ির মত দাঁড়িয়ে আছে। দোকানপাট সব বন্ধ। এমনিতেই গ্রামেগঞ্জে এগারোটা মানে অনেক রাত, তার ওপর আজ যেন একটু বেশিই নিঝুম। স্কুলের কাছে বেদেদের নতুন আস্তানা থেকে এই ক'দিন আগে অবধিও গল্পগুজব, গানবাজনা, রেডিও, বাচ্চাদর কান্না ভেসে আসত, আজ ক'দিন যাবৎ তারাও সব চুপ। এমনকী দিনের বেলাও তাদের সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। চলে-টলে গেল নাকি?

শুধু মশা আর ঝিঁঝির ডাক। কী একটা উড়ে গেল মাথার কাছ দিয়ে। চামচিকে? বোধহয়।

***

কারখানার দারোয়ান বসে বসে ঢুলছে। অবিশ্যি বন্দুকের যা ওজন, জেগে থাকলেও বিশেষ সুবিধে করতে পারত বলে মনে হয়না - উঠে দাঁড়িয়ে তাক করে গুলিটুলি করার আগেই মারধর খেয়ে যেত। পা টিপে টিপে সুরজিৎ ঢুকে পড়ল কম্পাউন্ডে।

মূল ঘরের বাইরে একটা জুতোর তাক। তাতে অনেক জুতো। আর একটা ব্যাগ, বড়। টিপেটুপে দেখে বুঝল, জামাকাপড়। স্বাস্থ্যদপ্তর থেকে ইন্সপেক্টর আসতে পারে, তাই হয়ত এই ব্যবস্থা - কারখানায় ঢোকার আগে কর্মচারীদের পরিস্কার জুতো, কাচা জামা পরা। ইন্সপেক্টর চলে গেলেই আবার যে-কে-সেই। হাসিও পায়। নিজেও জুতো খুলেই ঢুকল।

ও গল্পে পড়েছে, মাথার ক্লিপ দিয়ে চোরেরা তালা-ফালা খুলতে পারে। তবে কেমিস্ট্রির ছাত্র সে, জানে কোন্‌ অ্যাসিডে কাজ হয়। খুব সাবধানে পকেট থেকে ভায়াল বের করে ঢালল। প্রাগৈতিহাসিক আমলের কড়া: কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গলে গেল।

খুব সন্তর্পণে ভেতরে ঢুকল। পাশাপাশি দুটো মাংস কাটার গোল করাত, এককোণে রাখা। অন্ধকারেও চকচক করছে। বেশ ধারালো, দেখেই বোঝা যায়। মেঝেতে কাল রাতে কেনা বস্তার মধ্যে অল্প একটু নুন এখনও। আর একটা বড় কালো প্লাস্টিকের প্যাকেট।

ঘরের ঠিক মাঝখানে একটাই ফ্রিজার, তবে বড়। বেশ বড়। আর একদম নতুন। এটায় আর চাবি দেওয়া নেই। সুরজিৎ খুলে দেখল, মাংস। প্রচুর মাংস। নানান্‌ মাপের টুকরো, স্লাইস, সব আলাদা আলাদা বাক্সে ভরা, নুন মাখানো।

এত মাংস আসছে কোত্থেকে? নতুন কোনো খোঁয়াড় ওরা কেনেনি, সুরজিৎ খোঁজ নিয়ে জেনেছে। তাহলে?

ফ্রিজারের দরজা বন্ধ করল সুরজিৎ। সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজল, কিচ্ছু নেই। প্রত্যেকটা তাক উল্টেপাল্টে দেখল, শুধু নানান্‌ কাগজপত্র, ফাইল, অফিস স্টেশনারি, দুয়েকটা খালি জলের বোতল, এককোণে একটা অ্যাকোয়াগার্ড। খুঁটিয়ে দেখল, প্রতিটা জিনিস, প্রতিটা কোণ। একটা কিচ্ছু নেই কোথাও। অবিশ্যি, কী খুঁজছিল, সে বিষয়ে ও নিজেও নিশ্চিত নয়।

ঐ প্লাস্টিকের প্যাকেটটা শুধু দেখা বাকি। ওটা দেখেই বেরিয়ে যাবে। এই মাঝরাতে মশার কামড় খেয়ে শুধু শুধু ফালতু...

টর্চ জ্বেলে দেখল, প্যাকেটটা আসলে কালো নয়। স্বচ্ছ। ভেতরে কালো কী একটা আছে। ভর্তি।

নিচু হয়ে হাত দিয়ে দেখল, নরম। সুতোর মত। ব্যাগভর্তি কালো সুতো? মাংসের প্যাকেট বাঁধার জন্য?

কিন্তু সুতো কি এত নরম হয়? আর এত ছোট ছোট? আর সুতোর তো রীল হয়, এইর'ম গোছা গোছা, চাপ চাপ হয় নাকি?

তাহলে...?

চোখের সামনে কলকাতার সেলুনের মেঝে ভেসে উঠল। সুরজিৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ল বৈদ্যুতিক করাত আর ফ্রিজারের ঠিক মাঝখানটায়।

***

"বলেছিলে যে আর নুন লাগবে না?"

"হরেনদা, আজ এক বস্তা লাগবে না। তবে লাগবে খানিকটা। আর তাড়াতাড়ি দাও, কলকাতা থেকে বড় অর্ডার আছে, এখনই পাঠাতে হবে। সব মাল প্যাক হয়ে গেছে, সামান্য একটু বাকি।"

Followers