আজ বেশ
গরম। একবার জলে না নামলেই নয়।
তেল–টেল
মেখে জলে নামতে গিয়ে খোকন লক্ষ করল যে নদীর
ওপারে অনেক ছেলেমেয়ের ভিড়। স্বাভাবিক। আজ যা গরম, ইস্কুল শেষ হতেই সব জলে নেমে
পড়েছে।
ক্ষীরনদীর
জল ঠিক আর পাঁচটা নদীর মত নয়। বেশ পরিষ্কার, এমনকি
হয়ত স্বচ্ছও বলা চলে। এপারে নানান্ পাখি, কাক
চড়াই শালিক পায়রা কাদাখোঁচা, ডেকে উঠছে মাঝেমধ্যে।
এই
ভরা জল গ্রীষ্মেও বেশ ঠাণ্ডা। আরামে চোখ বুজে এল খোকনের।
ঘাট থেকে কয়েক পা এগিয়ে সে গা এলিয়ে দিল। কয়েকটা ডুব, তারপর
জলে গলা অবধি ডুবিয়ে ভেসে রইল।
কী হল?
সবাই
এত চুপ কেন হঠাৎ?
খোকন
চোখ খুলল। ওপারে, অনেকদূরে ছেলেমেয়েগুলো খেলছে।
কিন্তু এপারে? ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, বাকি
পাখিগুলো বেপাত্তা। শুধু কয়েকটা পায়রা।
খোকন
পায়রা চেনে। এগুলো লক্কার মত বড়, সাদা
নয়, এদের ঠোঁটও গোলাপি নয়। এগুলো ধূসর, চোখের
পাশে সাদা বৃত্ত, সাইজেও ছোট। মাথায় ঝুঁটিও আছে।
এগুলোকে বলে নোটন।
শুধু
কয়েকটা নোটন পায়রা। সেগুলো উড়তে শুরু করল। নদীর দিকে।
পায়রা
কি নদীর দিকে ওড়ে? ওরা থাকে তো ডাঙায়, হঠাৎ এদিকে আসবে কেন?
ওদের
পায়েই বা কী বাঁধা? চিঠি? চিঠি
এত বড় হয়? আর সবাই নদীতে আসছে কেন?
খোকনের দিকেই আসছে কেন?
এটা কী
তাহলে পায়রাদের একটা বাহিনী? খোকনকে
আক্রমণ করছে ওরা? কিন্তু কেন?
খোকন
কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরেকটা কেউ জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। খোকনের পাশে এসে দাঁড়িয়ে
একবার বুক ভরে শ্বাস নিল, তারপর দাঁত থেকে জিনিসটা বের
করল।
একটা
কলম।
খোকন
কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটা পায়রাগুলোর দিকে কলমটা ছুঁড়ে মারল। নিমেষের মধ্যে একটা সাংঘাতিক বিস্ফোরণ ঘটল।
পায়রাগুলো নিশ্চিহ্ন হল ঠিকই, কিন্তু কিছুর একটা টুকরো উড়ে
এসে খোকনের কপালে লাগল।
“কী হল?”
“উঃ!
বড্ড লেগেছে!”
*
“খেয়ে
নে খোকন।”
“না, আগে
পুরোটা বলুন।”
“আপনি-আপনি
করতে বারণ করলাম না।”
“ঠিক আছে,
বেশ। পুরোটা বলো।”
“অবাধ্যতা
করিস্না। আমি এইজন্য পায়রাগুলোকে মারলাম? এইজন্য
তোকে বাঁচালাম? দুধ–ভাত মেখে রেখেছি, খেয়ে
নে। কাকে খেয়ে যাবে নয়তো।”
“বেশ, খাচ্ছি, কিন্তু
ততক্ষণ বলো, তুমি কে? কেন
বাঁচালে?”
“বললাম
তো, আপাততঃ ধরে নে, আমি
তোর দাদা।”
“ধরে
নে মানেটা কী? মানছি যে তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ।
তার বদলে যদি চাও, তোমাকে দাদা
বলে ডাকতে পারি। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে
সত্যিই তুমি আমার দাদা!”
“ধরে
নে তাইই।”
খোকন
একটু অবাক হলেও খাওয়া বন্ধ করল না।
শুধু
দুধ–ভাত নয়। কলা, গুড়, আরো
নানারকম দিয়ে মাখা, প্রায় পায়েসই। আশ্চর্য
ব্যাপার, ‘দাদা’ একবার বারণ করার পর
কাকগুলো আর এমুখো হচ্ছেনা। একটু আগেও দেখেছে, গোটাদশেক
কাঠবেড়ালি ‘দাদা’র কথা শুনে পেয়ারা, গুড়–মুড়ি, দুধ–ভাত, বাতাবিলেবু, লাউ, মানে
রাজ্যের খাবার খেয়ে গেছে। এইসব দেখে তার ধারণা হয়েছে ‘দাদা’র কথা বোধহয় এইসব
জন্তুজানোয়ারেরা শোনেটোনে।
“কলমটায়
কী ছিল, দাদা?”
“ওঃ, ওটা
ছোট্ট হাতবোমা, কিন্তু বেশ শক্তিশালী।
পায়রাগুলোর পায়ে নানান্ অস্ত্র বাঁধা ছিল, সবকটাকে
না মারলে তুই যেতিস্।”
“কিন্তু
কারা আমাকে মারতে চায়? আর তুমিই বা অত ঝুঁকি নিয়ে
আমাকে বাঁচালে কেন?”
‘দাদা’
বেশ অন্যমনস্ক হয়ে গুনগুন করে একটা বেসুরো গান গাইতে লাগল, আর
শোলা দিয়ে একটা অস্বাভাবিক ছোট্ট কী বানাতে লাগল।
“উত্তর
দিচ্ছ না কেন? আর এটাই বা কী বানাচ্ছ?”
“ম্ম্ম্, এটা?
আজ কলাবাদুড়ের বিয়ে, টোপর
বানাতে হবে একটা।”
খোকন
ঠিক শুনল তো?
“কী
বললে?”
“ঠিকই
শুনেছিস্। আজকাল বউয়েরা খুশি হয় না চট্ করে, তাদের
দিব্যি ভালোমন্দ–জ্ঞান আছে। এই আমাকেই দেখ্ না: আমার বউ গাছ এত ভালোবাসে, আতা
আর ডালিম গাছ লাগালাম, তাতেও বউ ডাকলে সাড়া দেয় না।
এখন তো আতাগাছভর্তি টিয়াপাখি, ডালিম গাছেও এতবড় মৌচাক, কিন্তু
বাড়ির অবস্থা যে-কে-সেই।”
একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদা টোপর বানাতে লাগল।
“তুমি
আমাকে বাঁচালে কেন?”
“আমি
তোকে আগেও বাঁচিয়েছি, মনে নেই?”
“কবে?”
“তুই একবার মাছ ধরতে গেছিলি, মনে
আছে? এই ক্ষীরনদীতেই?”
“সেই
যেবারে চিল...?”
“হ্যাঁ।
খুব সম্ভবতঃ তুই আরেকটু থাকলে তোকে জলে ফেলত ওরা। আর তারপর ডুবিয়ে মারত। মাছটা
সাধারণ মাছ নয়, সম্ভবতঃ রোবট, আর
ছিপের নিচেও চুম্বক লাগানো ছিল। তোকে মারার পুরো প্ল্যান রেডি ছিল।”
“তারপর?”
“তারপর
আর কী? আমার চিল মাছ নিয়ে উড়ে বেরিয়ে গেল, কিন্তু
তাতেও বিপদ কাটেনি। কোলাব্যাংকে বলেছিলাম তোর ছিপটা কেড়ে নিতে, কিন্তু
সে তখন তাঁতির বাড়ি বসে সোনার সঙ্গে
গলা সাধতে ব্যস্ত, পাজামার নাড়া বাঁধারও সময়
হয়নি। যাক্গে, শেষ মুহূর্তে খেয়াল হওয়ায় গিয়ে কেড়ে
নিয়েছিল বলে বেঁচেছিলি, নয়ত ঐ চুম্বক তোকে টেনে নামাত।”
“তুমি...?”
“আরও
আছে। মনে আছে, ক্ষীরনদী পার হচ্ছিলি একা?
মাঝি অসুস্থ হয়ে পড়ল হঠাৎ করে?”
“হ্যাঁ, বেশ
ভয় পেয়ে গেছিলাম। আমি সাঁতার জানলেও কখনও নৌকো চালাইনি, আর
সেদিন বেশ ঝড়বৃষ্টি ছিল। কোত্থেকে সাতটা কাক এসে দাঁড় বেয়ে আমাকে পৌঁছে দিল।”
‘দাদা’
মৃদু হাসল।
“আজকেও
আমি নিজে যেতাম না। কিন্তু বাকি পাখিগুলো ভয় পেয়ে গেল যে!”
“আসল প্রশ্নের উত্তর কিন্তু তুমি এখনও দাওনি।
কেন বাঁচাও আমাকে তুমি?”
“কারণ
আমি জানি ছোটবেলায় তোর ওপর দিয়ে কী গেছে। একটার পর একটা...”
“তুমি
জানো? কিন্তু...”
“হ্যাঁ
রে। প্রত্যেকটা। আর তুই বাড়ি থেকে কেন কীভাবে পালিয়েছিলি, তাও
জানি।”
“আমি
পালাইনি দাদা। খুব কষ্ট হয়েছিল, তাই জঙ্গলে চলে গেছিলাম। আমি
থাকতে চাইনি। কারণ আমি জানতাম, কে করছে। শেষে বুঝে গেছিলাম।”
“তুই
জানিস্?”
“হ্যাঁ।
আমি আর ছোড়দা যখন ব্যাং ধরতে যাই, তখন
ছোড়দাকে সাপে কামড়ায়। কিন্তু সাপটা ঢোঁড়া ছিল, মরার
কথাই নয় ছোড়দার। বিষ তো মেশানো হয়েছে তার পরে।”
“কে, তুই
জানিস্?”
“দাদা, আমার
বাবা ডাক্তার, জানো তুমি?
শহরের সবথেকে বড় ডাক্তার? আর
আমরা তো সৎ ছেলে, মার আগের পক্ষের ছেলে। আমাদের
মারতে সৎ বাবার হাত কাঁপবে কেন?”
“তুই
এটা বুঝতে পেরেছিস্?”
“আলবাৎ। কিন্তু আমি পালানোর পর আবার মারার চেষ্টা কে করল? বাবা কি জেনে গেছিল?”
“অনেকদিন। আর তারপর থেকেই নানাভাবে মারতে চাইছে, কিন্তু
প্রতিবার আমি ভেস্তে দিয়েছি। বাকি ভাইদের জন্য পারিনি। কাঠ কাটতে
গিয়ে মামুলি চোট থেকে ধনুষ্টঙ্কার, ভাত খেতে
বসে ফুড পয়জনিং, গাছ থেকে পড়ে বা নাচতে গিয়ে
পিছলে পড়ে হাড় ভেঙে জ্ঞান না ফেরা, এর প্রত্যেকটার জন্য যে বাবা দায়ী, সেটা আজ বুঝি।”
“আর
বাকিরা?”
“বাকিরা?”
হাসল দাদা। “দুজন জলে ডুবে, আর একজন বাঘের পেটে। মনে করে দেখ্,
তিনবারই বাবা ওদের পাঠিয়েছিল, তাই না?”
“কিন্তু বড়দা?
তাকেও কি ভাড়াটে গুণ্ডা –”
মুচকি
হাসি।
“তুমি?
তুমিই?”
আবার
মুচকি হাসি।
“বড়দা!
সত্যিই তুমি?” খোকন বোধহয় কেঁদেই ফেলবে এবার: “এত বছর কোথায় ছিলে?”
“আমি
খানিকটা আগে থাকতে আঁচ পেয়েছিলাম রে। একটা ট্রেন ধরে বনগাঁ চলে গেছিলাম। ওখানে
মাসি আর পিসির খই আর মোয়ার কারবার। ক’দিন
ওখানেই ছিলাম। তবে ওরা যা কিপ্টে, ব্যবসা
থাকলে কী হবে, বিশেষ খেতে-টেতে দিত না। তারপর
একটা ট্রেন ধরে চলে গেলাম কালনা।”
“কালনা?”
“হ্যাঁ। ছিলাম কয়েকবছর। পাঁচজন মহিলা, বিয়ে-থা হয়নি, আমাকে
নিজের ছেলের মত বড় করল।”
“কারা
এরা?”
দাদার
মুখ একটু লালচে হল। “ওদের এক দিদি আছে, তার
নাতবৌ আমাদের পাড়ায় থাকত – মনে আছে? ক্ষান্তমণি।”
খোকনের
হাসি পেলেও চুপ করে রইল। ক্ষান্তদির প্রতি দাদার দুর্বলতার কথা পাড়ায় সবাই জানত।
কিন্তু এখন হাসার সময় নয়।
“বুড়িগুলো
একটু অদ্ভুত। সবই উল্টোপাল্টা করত। কিন্তু আমাকে ভালোবাসত খুব। ওরাই আমাকে নিজের
ছেলের মত দেখত বলতে পারিস্। তোর খবর অবিশ্যি ক্ষান্তই দিত আমাকে। আমি জানতাম তুই
বেঁচে গেছিস্। তাই কিছুদিন পরেই তোকে খুঁজে বের করলাম, তারপর
তোকে বাঁচাবার চেষ্টা করলাম বারবার।”
“তুমি
ফেরার চেষ্টা করনি?”
“প্রথম
প্রথম ইচ্ছে করত না। কেন ফিরব? কার কাছেই বা ফিরব? ক্ষান্ত বলেছিল যে সবাই জানে
আমি মরে গেছি, সুতরাং লুকোনোটাই বুদ্ধিমানের কাজ হত। কিন্তু তারপর জানতে পারলাম
তোর ওপর হামলা চলছে।”
আতাগাছ
থেকে টিয়াপাখিটা সমানে “খোকন” “খোকন” করে যাচ্ছে। বাড়ির খড়ের চালে একটা ফিঙে
নাচছে। একটা উদ্বেড়াল কোত্থেকে এসে ছড়িয়ে রাখা খুদ খাচ্ছে।
খোকন
বুঝল, ওর চোখ ক্রমশঃ জলে ভিজে আসছে। অন্যদিকে তাকাল সে।
*
“দাদা, বাবা
এটা কেন করল?”
“টাকার জন্য। মা মারা যাওয়ার পর মার
সম্পত্তির এগারোভাগ হত। আমাদের সরিয়ে এখন
সবকিছুর মালিক হয়ে বসেছে। ব্যাপারটা মোটামুটি এইই জানতাম। কিন্তু এখন...”
“এখন?”
“এখন
বুঝি ব্যাপারটা অন্যরকম। এই যে, আবার বিয়ে করল...?”
“বিয়ে?
আবার?”
“হ্যাঁ।
বাচ্চাও হবে।”
“কাকে
বিয়ে করেছে?”
“তুই
নাম শুনিস্নি হয়ত। আমাদের গ্রামের নয়। কিন্তু খুব, খুব
মারাত্মক মহিলা। খুনী।”
“খুনী?”
“আমার ধারণা বাবার সঙ্গে মহিলার সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই। আমাদের সরানোর
বুদ্ধি এই মহিলারই। হারাধন ডাক্তার প্রথম প্রথম আমাদের
ভালোই বাসত, মনে করে দেখ্। আর এত বছর পর খুঁজে পেয়ে হয়ত খুশিই হত।”
“হত?”
“মহিলার
বাচ্চা হবে, আমি জানতে পেরেছি। এও জানতে পেরেছি যে এই বাচ্চাটা অন্যের। এটা জানতে
পারলে বাবা ওকে আর আস্ত রাখত না।”
“রাখত
না মানে?”
“আমার
কাছে যা খবর আছে, তাতে ও বাবাকে কাল রাত্রে খুন করেছে। আর তার পরেই তোর ওপর আক্রমণ।”
টিয়াপাখিটা
থেমে গেল হঠাৎ। ঘন জঙ্গলের মধ্যে বাড়ি, তাই
চট্ করে বোঝা শক্ত, কে, কিন্ত
পায়ের আওয়াজ স্পষ্ট। আর সেটা এগোচ্ছে। আরো কাছে।
কীসের
আওয়াজ? স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে দুপেয়ে জীব, কিন্তু
নিশ্চিতভাবে মানুষ নয়।
গাছের
ফাঁক থেকে একটা কিম্ভূতকিমাকার মূর্তি বেরিয়ে এল। সাধারণ মানুষের থেকে উচ্চতায়
অনেক কম। নির্মম গোল দুটো চোখ। হাঁটার মধ্যে একটা অদ্ভুত ছন্দ আছে। আর সবথেকে
অদ্ভুত ব্যাপার, মাথার ওপরে রক্তের দাগ শুকিয়ে
যাওয়া, সাংঘাতিক ধারালো দুটো শিং।
“খোকন, এঁর কথাই বলছিলাম। এঁর শিঙে লেগে থাকা রক্তটা বোধহয় বাবার। আসুন, টিম্টিম্
দেবী।”
*
“তোরা
সবই জানিস্, তাই না?”
“হ্যাঁ।
আশাকরি বুঝতে পারছেন যে আমিই সেই হারিয়ে যাওয়া বড় ছেলে।
আর আমার ভাইয়ের কথা তো আপনি জানেনই। সুতরাং এবার আপনি সম্পত্তির মোটে তিনভাগের
একভাগ পাবেন। বাকিটা পাব আমরা।”
“তার
জন্য তোদের বেঁচে থাকতে হবে তো!” মাথা নিচু করে অভ্রান্ত লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল
হাট্টিমা। সে পেশাদার খুনি। খোকন শেষ মুহূর্তে সরে যাওয়ায় হাতে ঘষে গেল হাট্টিমার শিং।
তাতেই গলগল করে রক্ত বেরোতে লাগল।
শিকার
ফস্কে যাওয়ায় হাট্টিমা অধৈর্য হয়ে আবার ঝাঁপাল। কিন্তু দাদা প্রস্তুত ছিল, অনায়াসে
পাশ কাটাল। আবার ঝাঁপাল, আর এবার দাদার কোমরে বেশ জোরে
লাগল।
খোকন
ঝাঁপিয়ে পড়ল, ধাক্কা দিতে চেষ্টা করল, কিন্তু
হাট্টিমা অসম্ভব ক্ষিপ্র। নিমেষের মধ্যে ঘুরে সে শিং বসাল খোকনের ডান ঊরুতে।
দুজনেরই যদিও এখনও তেমন গুরুতর চোট লাগেনি, এইর’ম
আর কয়েকটা হলে বাঁচানো শক্ত হবে।
হাট্টিমার
মধ্যে অবশ্য
ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই। স্পষ্ট বোঝা যায় সে এইধরনের লড়াইয়ে অভ্যস্ত, দুজন
নিরস্ত্র মানুষ তার কাছে কোনো ব্যাপারই নয়।
আবার
হাট্টিমা ঝাঁপাল। খোকনের বাঁ ঊরুতে আঘাত করে ফালাফালা করে দিল। খোকনের উঠে
দাঁড়ানোর ক্ষমতাটুকুও রইল না। দাদা কোমরে হাত চাপা দিয়ে তখনও শুয়ে।
দাদা এতবার
বাঁচিয়েছে তাকে। প্রতিদান দিতে পারল না খোকন।
কিন্তু
এটা কী হচ্ছে?
হাট্টিমা
টিম্টিম্ মাটিতে পড়ল – হঠাৎই, আর পেট চেপে ধরে চিৎকার করতে
লাগল। অদ্ভুত একটা শ্বাসকষ্ট, পাগলের মত ছট্ফটানি, একটা
আর্তনাদ...
দুভাই
কোনোমতে গড়িয়ে গড়িয়ে পৌঁছল হাট্টিমার কাছে। ততক্ষণে সব শেষ।
তারাও
জ্ঞান হারাল।
*
খোকনের
জ্ঞান ফিরল হাসপাতালে। পাশের বেডে দাদা।
“ঠিক
আছিস্?”
খোকন
হাসল।
“যাক্, যা
হওয়ার হয়ে গেছে। হাট্টিমা বাঁচেনি, জানিস্
তো।”
চুপ করে রইল খোকন।
“কীভাবে
মরল জানতে চাস্ তো? খুব সহজ। বলেছিলাম না
ওর বাচ্চা হবে? আসলে
ভুলে গেছিলাম, মানুষের মত ওর বাচ্চা হয়না ওদের।
ওরা ডিম পাড়ে। আর সেটা মাঠেই পাড়ে। ডিম পাড়ার সময় চারপাশ থেকে হাওয়া না দিলে আর
মাথার ওপর সূর্য না থাকলে ওরা অসুস্থ হয়ে পড়ে।
“ঠিক
তাইই হল। আমাদের বরাত ভাল যে ওর প্রেগনেন্সির একদম শেষ স্টেজ ছিল। আমার বাড়িটা ঘন
জঙ্গলের মধ্যে, তার ওপর সন্ধেবেলা। ও না পেল চারপাশ
থেকে হাওয়া, আর না মাথার ওপর রোদ্দুর। আর খুনি হোক আর যাই হোক, মারপিট করতে গেলে একটা ধকল যাবে না?”
খোকন
আবার হাসল। এবার সে নিরাপদ। সম্পূর্ণভাবে। ইস্স্, বাকি
দাদারা যদি থাকত। যাক্, যা আছে, তাই
বা ক’জনের থাকে?
এক
মহিলা ঢুকলেন রিপোর্ট হাতে। নির্ঘাত বৌদি। আর তখনই – অন্য দরজা দিয়ে ক্ষান্তদি।
খোকন
চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। ঘুমোনোর ভান করে।