উৎস: চতুষ্কোণ-এর ফেসবূক পেজ |
আমি আজন্ম থ্রিলার ভালবাসি, কাজেই সিনেমাটা কতটা
জমবে তা নিয়ে রীতিমত সন্দেহ ছিল। বাইশে শ্রাবণ মন্দ লাগেনি, কিন্তু এটা
নাকি আরও ভাল – ইন ফ্যাক্ট, লোকের কথা অনুযায়ী জাতিস্মর-এর থেকেও ভাল।
তুলনার মধ্যে যাচ্ছি
না, কারণ জাতিস্মর আর চতুষ্কোণ এতটাই আলাদা যে তুলনা করতে যাওয়াটাই
অযৌক্তিক।
***
এখান থেকে কিছু স্পয়লর
আছে।
অনেক ভাট হয়েছে, এবার
রিভিউয়ে আসি। এই সিনেমাটা দেখেই যে দুটো কথা মনে হল সে’দুটো আগে বলি –
১) এই সিনেমাটা দেখলে আগাথা
ক্রিস্টির কথা মনে পড়তে বাধ্য;
২) গন্ধ পেলেও চতুষ্কোণ-এর সঙ্গে আগাথা ক্রিস্টির কোনও
গল্পের সঙ্গে মিল নেই।
কিন্তু গল্পটাও আসল নয়।
আসল হল সৃজিতের দুর্দান্ত, ঝক্ঝকে চিত্রনাট্য। সিনেমায় দুটো মূল ঘটনা, কয়েক দশকের
ব্যবধানে। বেশিরভাগ ভারতীয় পরিচালকই এক্ষেত্রে ফ্ল্যাশব্যাকের সাহায্য নিতেন।
সৃজিৎ সেটা অনায়াসে করতে পারত, কিন্তু ঐ, বাঙালির মাথায় পোকা নড়লে যা হয় – দুটো সমান্তরাল
গল্পের রাস্তায় গেল।
কাজটা কঠিন ছিল, কিন্তু
সৃজিৎ চ্যালেঞ্জটা নিয়েছে। আর পরীক্ষায় বেশ অনার্স-টনার্স সমেত উতরে গেছে। দুটো
সমান্তরাল গল্প ছাড়াও চতুষ্কোণ-এ কয়েকটা ছোটখাট গল্প আছে
(বলে দিলে মজা নষ্ট হয়ে যাবে), সেগুলোও বেশ সুন্দরভাবে বলা। সবথেকে বড় কথা,
গল্পগুলো – মূল আর পার্শ্বিক – এত সাবলীলভাবে একে অন্যের সঙ্গে বিচরণ করেছে যে সব
মিলে একটা চমৎকার সিনেমা হয়েছে।
চতুষ্কোণ-এ গল্প ছাপিয়ে দাগ কেটেছে চিত্রনাট্য। গল্পটা সত্যি
বলতে অসামান্য নয়; ক্লাইম্যাক্স আসার আগেই মোটামুটি বোঝা গেছে। কিন্তু ঐ – ভাল গল্প
আর ভাল সিনেমা তো এক নয়; টানটান গল্প মানেই যেমন গায়ে কাঁটা দেওয়া সিনেমা নয় (চিড়িয়াখানা)
তেমনই উল্টোটাও সত্যি; টানটান সিনেমার জন্য ভাল গল্পের দরকার হয় না (সোনার
কেল্লা)।
এখানেই চতুষ্কোণ-এর সাফল্য। চতুষ্কোণ দুর্দান্ত, কিন্তু
সেটা গল্পের জন্য নয়। চতুষ্কোণ দুর্দান্ত, কারণ তার স্ক্রিপ্ট অসাধারণ, তার
মেকিং দারুণ, হল থেকে বেরোলেও চট্ করে মন থেকে যায় না, আর সবথেকে বড় কথা, আবার
দেখতে ইচ্ছে করে (এর থেকে বড় কমপ্লিমেন্ট থ্রিলারের জন্য আর কী হতে পারে?)।
ইমোশনের বাড়াবাড়ি নেই কোথাও, দুটো আলাদা গল্পের
মধ্যে বিচরণ অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ, কৃত্রিম মনে হয়নি কখনও, ঘটনার ঠাসবুনোটের ফলে সিনেমার
গতি কোথাও কম্প্রোমাইজ্ড্ হয়নি।
গতি।
চতুষ্কোণ-এর সবথেকে বড় ইউএসপি হল তার গতি, আর তার ওপর
সৃজিতের নিয়ন্ত্রণ। গতি মানে কিন্তু উসেন বোল্টসুলভ তিনটে-খুন-চারটে-ডাকাতি-সত্তর-মিনিটে
সিনেমা-শেষ নয়; এখানে সিনেমার রাশ সৃজিতের হাতে, যেখানে টানা দরকার টেনেছে, যেখানে
ছাড়া দরকার ছেড়েছে।
[টুকটাক কিছু বাড়তি, অপ্রাসঙ্গিক দৃশ্য ঢুকেছে
হয়ত, কিন্তু ঠিক আছে।]
সংলাপের প্রসঙ্গে আসি। সৃজিতের সিনেমায় সংলাপ
আমার একটা বরাবরের অস্বস্তির জায়গা: সবাই সামহাউ খুব
বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলে। এখানে যেহেতু সিনেমার মূল চরিত্রের প্রত্যেকে বুদ্ধিমান্,
বিদগ্ধ, তাই তাদের মুখে সংলাপ বেমানান লাগেনি। ঘ্যাম লোকেরা তো ঘ্যাম ডায়লগই দেবে,
তাই না?
আমি ক্যামেরার কাজ খুব
কম বুঝিটুঝি, কিন্তু প্রথম দৃশ্যটা অনেকদিন মনে থাকবে। আর মনে থাকবে জয়ব্রত
(পরমব্রত) আর তৃণা (অপর্ণা)-র গলায় খুব, খুব প্রাসঙ্গিক জয় গোস্বামী।
[সিনেমায় অনেকগুলো সুন্দর,
সূক্ষ্ম রেফারেন্স, অ্যানোটেশন আছে। বলে দিয়ে মজা নষ্ট করব না।]
পরমব্রত স্মার্ট, ইন
ফ্যাক্ট, অনেকদিন এত ভাল অভিনয় করতে দেখিনি। অপর্ণা নিয়ে নতুন করে তো কিছু বলার
নেই; এখানে গৌতম ঘোষের রোল বাইশে শ্রাবণ-এর মত বলিষ্ঠ নয়, বরং চতুষ্কোণ-এর এক্কেবারে শেষ, চতুর্থ কোণ হয়ত তিনিই। ছোট ছোট
ভূমিকায় নীল, অর্পিতা, কনীনিকা, দেবলীনা, শান্তিলাল হতাশ করেন নি। কৌশিক গাঙ্গুলি,
বরুণ চন্দ রীতিমত ইম্প্রেস করেছেন; রাহুল-ইন্দ্রাশিস্-পায়েলও খারাপ না।
কিন্তু – চিরঞ্জিৎ! চিরঞ্জিৎ! কেউ ভেবেছিল? কী
করলেন স্যার, কুড়ি-পঁচিশ বছর জলে দিলেন? এইর’ম অভিনয়ের ক্ষমতা রাখেন আপনি, এইভাবে
নষ্ট করলেন? অনেকদিন থাকবে স্যার, আপনার অভিনয়। কী অনায়াস অভিনয়, জঙ্গলের দৃশ্যে
এমনকি অপর্ণাকেও ম্লান করে দিলেন স্যার!
শ্রেষ্ঠ কোণ এক্কেবারে নিঃসন্দেহে আপনি। আপনার
মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। চতুষ্কোণ এমনিতেও দুর্দান্ত, কিন্তু আপনি ব্যাপারটাকে
একটা অন্য স্তরে নিয়ে গেলেন। আপনার টালিগঞ্জকে অনেককিছু দেওয়ার আছে; নিন, অনেক হয়েছে,
এবার একটা একটা করে এইরপ’ম পার্ফর্মেন্স ছাড়ুন তো বাজারে!