'বর্ণদূত', দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা (১২ই আষাঢ় ১৪২৩) |
যুদ্ধক্ষেত্রে দৈনিক বরাদ্দ দু’মুঠো আটা; তাতে
পেট ভরলেও মন ভরে না। কোনও কোনও রাত্রে পেটও ভরে না। কোনওমতে চারটে রুটি সেঁকে
যেটুকু পেট ভরানো যায় আর কী।
তবে ঐ... গনগনে আগুনের আঁচে ঝলসানো রুটি... ভোরের
আগে নিভন্ত আগুনের ওমের আরাম... আর ক্লান্ত মুখগুলোয় আগুনের লালচে ছায়া... সব মিলে
কোথাও একটা ভাল লাগা লুকিয়ে থাকে।
নীলচে আগুনের শিখায় সেনজিৎ রোজ রাতে বেদবতীর মুখ
দেখতে পায়।
বেদবতীর চোখের আগুন আছে, আছে বিদ্যুৎ। আর চোখের
পাতায় আছে ঘুম। বেদবতীর চোখ সহ্য করতে পারে না সেনজিৎ, খড়কুটো যা পায় আগুনে ছুঁড়ে
দেয়, যাতে আরও দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে, বেদবতীর চোখ গিলে নেয় চিরতরে।
একাকিনী গৃহবধূর বিষণ্ণ চোখ মিলিয়ে যায় ঘুমের
দেশে। মিলিয়ে যায় বিদ্যুৎ, মিলিয়ে যায় আশ্রয়, মিলিয়ে যায় আঁচল। পরের রাত্রে যাওয়ার
আশ্বাসটুকু দেওয়ার সময় পায় না।
কিন্তু সে আসে, রোজ, ফিরে ফিরে আসে, দু’চোখের
নাগপাশে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতে চায় সেনজিৎকে।
মুক্তি নেই।
***
সেনজিতের দেশ নেই। রাজা বলতে প্রাগ্জ্যোতিষপুরের
ভগদত্ত। কার ঔরসে, কার গর্ভে, কোথায় তার জন্ম, ইতিহাস সে হিসেব রাখেনি।
না, জীবন তাকে একেবারে নিঃস্ব করেনি। সব কেড়ে
নিয়েও তার হাতে তুলে দিয়েছিল অসিচর্ম। মগধ কাশী কোশল চেদি কলিঙ্গে অর্থের বিনিময়ে
যুদ্ধ করত সেনজিৎ।
শত্রুর বুকে তলোয়ার বসিয়ে ফিনকি দিয়ে ওঠা রক্ত
দেখে তার মনে জাগত পাশবিক উল্লাস।
কিশোরীর অসহায়তায় উচ্ছ্বসিত হত সেনজিৎ। চরম
মুহূর্তে বারবার কোমল শরীরে ছুরি বসিয়ে ছিন্নভিন্ন করত সে।
রক্তের উষ্ণতা ছাড়া পূর্ণতা পেত না তার যুদ্ধ,
তার রমণ।
স্বর্ণমুদ্রার ঔদ্ধত্যে, অস্ত্রের ঝনকে তার নির্মম
আত্মবিশ্বাস ছিল গগনচুম্বী।
কীসের রাগ সেনজিতের, সে নিজেও জানত না।
তারপর সে এল প্রাগ্জ্যোতিষপুরে। আর চিনল
বেদবতীকে। চিনল তার চোখ।
জীবনে প্রথম সে নতজানু হল, আত্মসমর্পণ করল, কারণ
সেই চোখে ছিল আগুন, ছিল বিদ্যুৎ, ছিল বৃষ্টি, ছিল শান্তি, ছিল আশ্রয়, ছিল জীবন, ছিল
মৃত্যু।
তারপর কয়েকমাস স্বপ্ন দেখেছিল সেনজিৎ। তারপর তলব
এল।
অনেক বারণ করেছিল বেদবতী। শোনেনি সেনজিৎ।
মহারাজ ভগদত্ত হয়ত কিছু বলতেন না। কিন্তু আসমুদ্রহিমাচল
যখন কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধে সাড়া দিয়েছে, সে কীভাবে রমণীর আঁচলের আড়ালে লুকিয়ে থাকবে?
চোখের আকর্ষণ যতই তীব্র হোক্, শতসহস্র বছরে
পুরুষের শিরায়-ধমনীতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া যুদ্ধতৃষ্ণার টানে সাড়া না দিয়ে সে থাকবে
কীভাবে?
আর তাই, আজ, আগুনের লেলিহান, অবুঝ শিখায় বেদবতীর
নিঃশব্দ প্রতিশোধ। প্রতিনিয়ত।
***
কুরুক্ষেত্র থেকে হস্তিনাপুরের দূরত্ব কম নয়, তবে
অনতিক্রম্যও নয়। যুদ্ধক্ষেত্রের নিভন্ত আগুনের স্পর্শ নিয়ে রাজপ্রাসাদে ঢুকল ভোরের
হাওয়া।
রাত্রি দুই প্রহর। সজাগ প্রহরীর উদ্যত ভল্ল এড়িয়ে
প্রদীপের কম্পনরত শিখায় ঠোঁট ছোঁয়ায়।
ধৃতরাষ্ট্রের ঘুম আসেনি সে রাত্রে। দিনের পর দিন
সঞ্জয়ের মুখে ধারাবিবরণীতে অসহায় ধৃতরাষ্ট্র আঁকড়ে ধরতে চাইছিলেন গান্ধারীকে, বা
কোনও নারীদেহ। অন্ততঃ আজ রাত্রে।
গান্ধারী নিদ্রিত ছিলেন। পট্টবস্ত্রে ঢাকা চোখ
কখন মুদ্রিত হয়, পৃথিবী জানতে পারে না। ধৃতরাষ্ট্রও না।
স্বপ্ন দেখছিলেন গান্ধারী। যুদ্ধক্ষেত্রের
স্বপ্ন। সৈন্যশিবিরের স্বপ্ন। নিষ্ঠুর রাত্রির স্বপ্ন। ক্লান্ত পুরুষদেহের স্বপ্ন।
তখনই দেখলেন সেনজিৎকে। দেখলেন চোখ, তার দৃষ্টি, অনুভব
করলেন তার দু’চোখের ক্ষুধা।
পুরুষের লুব্ধ, কামাতুর দৃষ্টিতে অভ্যস্ত নন
গান্ধারী। এ অনভ্যাসের সিদ্ধান্ত তাঁর নিজের।
কিন্তু স্বপ্ন না দেখার প্রতিজ্ঞা তিনি, তাঁর
শরীর করেনি।
অস্বস্তি... চাপা... ছটফটানি...
কাতর, অস্ফূট, মূক শীৎকার...
কোথায় তুমি, সৈনিক? তুমি তো অন্ধ নও!
শরীর...
কোথায় তুমি, সৈনিক?
আগুন নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেদবতীর চোখও গেছে
হারিয়ে।
তলিয়ে যেতে থাকলেন গান্ধারী, আগুনের নিচে, একদম
ভেতরে কোথাও।
তারপর দপ্ করে জ্বলে উঠল আবার...
উত্তাপ...
আঃ...
সেনজিৎ উঠল না। গান্ধারীর স্বপ্নে কখনও তার ঘুম
ভাঙে না।
গান্ধারীর চোখে চোখ রাখতে পারে না সে। যেমন
পারেননি ধৃতরাষ্ট্র। বা অন্য পুরুষ।
***
সে রাতেও গান্ধারীর চোখের পট্টবস্ত্র ভিজে গেছিল।
হয়ত বা ঘামেই।