অনেক, অনেককাল আগের কথা। ‘আবার যখের ধন’ নয়, তারও
আগে, বোধহয় ‘তেরো পার্বণ’এর সময়কার। তখনও আমি ঐসব ব্যাপার কিছু বুঝতাম-টুঝতাম না। মন দিয়ে
পড়াশুনো করতাম, গল্পের বইটই পড়তাম, হয়ত শরৎচন্দ্রও পড়তাম।
এটা সেই যুগের কথা, যখন বাবা-মা অম্লানবদনে “এই ক’টা
বছর তো, তারপর বড় হলে দেখবি, কত মজা” জাতীয় ঢপ্ দিত, আর আমি মূর্খের মত হজম
করতাম। যাক্গে।
তখন একটা খেলা চলত বাজারে। জানি না এখনও চলে কিনা।
একটা কাগজ চারটুকরো করে (বা চারটে ছোট কাগজের টুকরো নিয়ে) তাতে লিখতে হত ‘বাবু’, ‘চোর’,
‘ডাকাত’, আর ‘পুলিশ’।
চারজনে খেলতে হত। কন্সেপ্টটা মোটামুটি মনে আছে। চারজন
গোল হয়ে বসত, আর কাগজের টুকরোগুলো মাঝখানে ছুঁড়ে দিত। সবাই র্যান্ডমলি তুলত।
‘বাবু’ আর ‘পুলিশ’কে জানাতে হত তারা কারা। তারপর ‘বাবু’
‘পুলিশ’কে বলতে বলত কে ‘চোর’ আর কে ‘ডাকাত’। যদ্দূর মনে পড়ছে এটা বলতে পারলে ‘পুলিশ’
দেড়শো পেত; আর ভুল বললে ‘ডাকাত’ একশো আর ‘চোর’ পঞ্চাশ। ধরা না পড়লে ডাকাতিবিদ্যা
সম্ববতঃ মহত্তর বিদ্যা।
সে যাক্। ‘পুলিশ’ ঠিক বলুক বা ভুল, তিনজনে মিলে
পেত দেড়শো। এই অবধি ঠিক ছিল।
সমস্যা হল, ‘বাবু’ পেত দুশো জাতীয় কিছু একটা। তিনশোও
হতে পারে। বা পঁচিশ। বা পাঁচ। বা এক কোটি। তাতে গল্পটা বদলাবে না।
না, এটাও সমস্যা নয়, কারণ ঘুরিয়েফিরিয়ে সবার
ভাগ্যেই বাবুগিরি জুটত। তখন লার্জ স্যাম্পল বুঝতাম না, কিন্তু লং রানে এগুলো ম্যাটার
করত না।
এইভাবে চুরি-ডাকাতি-বাবুয়ানি-গ্রেপ্তার করে দিন
কাটছিল। মুশকিল হল, একদিন মোটে তিনজন ছিলাম। আমি যথারীতি খেলতে চাইলাম (এই
বোকা-বোকা খেলাটার প্রতি এত নেশা ছিল কেন আমার?), কিন্তু বাকি দু’জন রীতিমত মুখঝামটা
দিয়ে উঠলঃ “তিনজনে চোরপুলিশ খেলা যায় না।”
“কিন্তু ‘বাবু’র তো কোনও ভূমিকা নেই। না থাকলেও
তো খেলাটা দিব্যি এগোবে। পুলিশ পুলিশের কাজ করবে। ঘুরেফিরে তো সেই
দেড়শো-শূন্য-শূন্য বা শূন্য-একশো-পঞ্চাশ।”
কিন্তু ওরা অনড়। চারজনের কমে চোরপুলিশ খেলা যায়
না। চারজনের বেশি হলে হয়ত হতে পারে (বাটপাড়-হানাদার-ঠ্যাঙাড়ে জাতীয় চরিত্র লাগত
হয়ত), কিন্তু বাবু ছাড়া অসম্ভব।
এই সামান্য জিনিসটা কেন সেদিন বোঝাতে পারিনি জানি
না। হয়ত আমার বোঝানোর টেকনিকে ভুল ছিল। বা হয়ত ওরা বোকা।
আজ বুঝি যে আমিই বোকা ছিলাম।
কিচ্ছু না করে পায়ের ওপর পা তুলে বসে স্রেফ ক্ষমতা
জাহির করে অন্যকে হুকুম করে দিনের শেষে রোজগার করার প্রতি বাঙালির অদম্য স্বপ্নকে
আন্ডারএস্টিমেট করেছিলাম।