মূল গল্প: He-y, Come On Ou-t!
লেখক: Shinichi Hoshi
অনুবাদ নয়, “ছায়া অবলম্বনে”
***
জোতশিবরামপুর ছাড়িয়ে অনেকদূর গেলে
মুজিবপাড়া বলে একটা গ্রামে একটা মঠ ছিল। একশো বছর আগে নাকি সেখানে জাগ্রত দেবতা না
কীসব ছিল, কিন্তু কার পুজো হত সে কারুর মনে নেই। তারপরে ঝড়-ঝঞ্ঝা-ভূমিকম্প-মহামারী
আরও কতকিছুর ধাক্কায় সেই মঠ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
তাই নিয়ে অবিশ্যি এত বছর কারুর মাথাব্যথা
ছিল না। তবে সম্প্রতি জেলা পঞ্চায়েতের টনক নড়েছে। টুরিস্ট টানতে নানান্ ফন্দিফিকির
আঁটছে তারা। এই মঠটাকে সাজিয়েগুছিয়ে রংচং মাখালে হয়ত কাজে দেবে।
*
গর্তটা প্রথম চোখে পড়ে মকরন্দ
বোসের। মঠ থেকে মিটারদশেক দূরে একটা গর্ত, প্রায় নিখুঁত বর্গাকার চারফুট বাই
চারফুট, ভেতরটা নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। জরিপের কাজে অনেক ঘুরেছেন তিনি, কিন্তু এইর’ম জিনিস
বাপের জন্মে দেখেননি।
আশপাশের গ্রামেগঞ্জে খোঁজ করেও কিছু
জানা গেল না। লাভের লাভ হল এই যে গর্ত ঘিরে হুজুগে বাঙালির ভিড় জমে গেল।
এই দিনের আলোতেও গর্তের ভেতরটা
একেবারে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। কোনও শব্দও নেই, জল বা কিছুর। পাশে দাঁড়িয়ে লোকজন
সম্পূর্ণ অকারণে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে লাগল।
“ভেতরে কে আছিস্, বেরিয়ে আয়!” গর্তের
কিনারায় দাঁড়িয়ে বেশ নাটকীয়ভাবে চেঁচিয়ে উঠল এক উঠতি যুবক, তারপর নিজের রসিকতায় নিজেই
হেসে উঠল। বিরক্ত হয়ে তাকালেন মকরন্দ বোস।
কেউ বলল শয়তানের বাসা, কেউ বলল
ব্ল্যাকহোল। এক বৃদ্ধ বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানালেন দেবতার অভিশাপে হয়েছে, যদিও
দেবতা খামোকা গর্ত খুঁড়তে যাবেন জিজ্ঞেস করায় তিনি চুপ করে রইলেন।
কিন্তু সেসব নাহয় হল, কী করা যায় এই
গর্ত নিয়ে? ঢাকলে বা ঘিরে দিলেও বিপদ থেকেই যায়। তার থেকে বুজিয়ে দেওয়া ভাল।
তবে তার আগে বোঝা দরকার কতটা গভীর।
গর্তের কিনারায় দাঁড়িয়ে একবার চিৎকার
করে উঠলেন মকরন্দ বোস। অভিজ্ঞ কান, প্রতিধ্বনি শুনে আর কিছু না হোক একটা মোটামুটি আন্দাজ
করতে পারেন।
কিন্তু কীসের কী? কোথায় প্রতিধ্বনি?
এবার রাস্তা থেকে একটা ছোট্ট
নুড়িপাথর কুড়িয়ে ছুঁড়ে দিলেন।
নাঃ, তাও সাড়া নেই।
ঠিক কতটা গভীর এই গহ্বর?
সঙ্গে যতগুলো দড়ি ছিল একসঙ্গে বেঁধে
নামিয়ে দিলেন মকরন্দ বোস। কিন্তু এবারও তল পেলেন না।
*
পরেরদিন জেলাদপ্তর থেকে বাসে চড়ে ইয়া
লম্বা লম্বা দড়ি সমেত উপস্থিত হলেন মকরন্দ বোসের সহকর্মীরা। দড়ির একদিক বাঁধলেন
বাসের গায়ে, অন্যদিকে ভারি পাথর বেঁধে নামিয়ে দিলেন।
কিন্তু তাঁরাও তল পেলেন না।
অগত্যা ডাক পড়ল বিজ্ঞানদপ্তরের।
কিন্তু তাঁরাও ফেল মেরে গেলেন।
চোঙার মত দেখতে বিকট যন্ত্রপাতি দিয়ে
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভয়ানক জোরে নানান্ শব্দ করে কাক-চিল উড়িয়ে কুকুর তাড়িয়ে আশেপাশে
সবার কানে তালা ধরিয়েও প্রতিধ্বনির ছিটেফোঁটাও পেলেন না তাঁরা।
টেকনিকাল কথা আদ্ধেক বুঝলেন না মকরন্দ
বোস, শুধু বুঝলেন যে হবে না।
*
প্রথমে একটু গাঁইগুঁই করলেও রাজি
হয়ে গেল গ্রাম পঞ্চায়েত। মঠটা যেখানে ছিল ঠিক সেখানে নয়, মুজিবপাড়ার একেবারে মাঝখানে
বানিয়ে দেবেন মকরন্দ বোস, তাও বিনামূল্যে।
বিনিময়ে শুধু চেয়ে নিলেন গর্তটা। কেউ আপত্তি করেনি।
আর তারপরেই ছেড়ে দিলেন সরকারি চাকরিটা।
*
বছরপাঁচেকের মধ্যে মুজিবপাড়া হয়ে
উঠল পশ্চিমবঙ্গের সবথেকে হাইপ্রোফাইল টুরিস্ট স্পট। এমনই তার রমরমা যে দমদম থেকে
নিউইয়র্ক লন্ডন প্যারিস মেলবোর্ন টোকিও সর্বত্র রোজ ফ্লাইট শুরু হয়েছে।
আর মাঠ-খেত মাটিতে মিশিয়ে বানানো চল্লিশ
লেনের হাইওয়ে দিয়ে দিনরাত শ’য়ে শ’য়ে ট্রাক চলে। তাতে করে আসে গোটা দেশের বর্জ্যপদার্থ
– ঐ, চুরমার করে পিটিয়ে পিটিয়ে সাড়ে তিন ফুট বাই সাড়ে তিন ফুট বাক্সে আঁটানো।
ডলারে ইউরোয় ইয়েনে এখন মুজিবপাড়াকে
চেনা দায়। জোতশিবরামপুর অবধি লাইন দিয়ে পাঁচতারা হোটেল, কারণ টুরিস্ট শুধু নয়, বিদেশী
বিনিয়োগকারীদের থাকার একটা জায়গা দিতে হবে তো!
হাইকোর্টের ফাইল থেকে পুরোনো প্রেমপত্র
থেকে পরিত্যক্ত সেলফোন থেকে প্লাস্টিকের পাহাড় থেকে অপরাধের প্রমাণ, সবকিছুর আলাদা
আলাদা রেট – আর তার সব যে আইন মেনে হয় তাও নয়।
তবে আসল টাকাটা আসে নিউক্লিয়র বর্জ্য
থেকে। কোটি কোটি। আর আসবে নাই বা কেন?
যাই ফেলা হোক্ ঐ বুভুক্ষু গর্ত
সব গিলে ফেলে, আর তাও হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হজম না করে ও খিদে বোধহয়
মেটার নয়।
আর তার সেই হাঁয়ের সামনে সেলফি
তোলার জন্য টিকিট কেটে লাইন দেয় বাচ্চা-বুড়ো-ছেলে-মেয়ে-নির্বিশেষে প্রত্যেকে।
সেই সেলফিতে জঞ্জাল থাকে না, কারণ
অপ্রয়োজনীয় সব এখন চলে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে।
*
মুজিবপাড়া টাউনশিপের মেয়র এখন মকরন্দ
বোস। ভোটের দরকার পড়েনি, কারণ আর কোনও প্রার্থী ছিল না। আজ তিনি খুশি। শোনা যাচ্ছে
নোবেল শান্তি পুরস্কারটাও পেয়ে যেতে পারেন তিনি। টাকা বা ক্ষমতা অনেকেরই থাকে,
কিন্তু এত বড় সম্মান?
শহরের ইন্ডাস্ট্রিও এখন ফুলেফেঁপে
উঠেছে। বর্জ্যপদার্থ নিয়ে আর মাথা ঘামানোর দরকার নেই কারুর।
অপ্রয়োজনীয় অবাঞ্ছিত কোনওকিছুরই
আর অস্তিত্ব নেই পশ্চিমবঙ্গে। শীগ্গিরি ভারতেও আর থাকবে না। তারপর গোটা পৃথিবীতে।
জানুয়ারির দুপুরে ছাদে গিয়ে
দাঁড়ালেন মকরন্দ বোস। এই ছাদটা মুজিবপাড়ার সবথেকে উঁচু জায়গা। চারপাশে অনেকগুলো তিরিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটতলা
বাড়ি আছে বটে, কিন্তু এটার ধারেকাছেও নয় সেগুলো।
আকাশটা পাঁচবছর আগের মত নেই, না? অনেক
ঝকঝকে হয়ে গেছে। সমুদ্রও তাই, দেখে এসেছেন তিনি।
এসব সাতপাঁচ ভাবছেন, আর তখনই
আওয়াজটা ভেসে এল, অনেক, অনেক ওপর থেকে, বেশ নাটকীয় গলায়: “ভেতরে কে আছিস্,
বেরিয়ে আয়!”
আর তারপরেই একটা গা-পিত্তি জ্বালানো
হাসি।
বিরক্ত হয়ে তাকালেন মকরন্দ বোস,
কিন্তু ওপর থেকে কীভাবে আওয়াজ আসতে পারে অনেক ভেবেও ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না।