BANNER CREDITS: RITUPARNA CHATTERJEE
A woman with the potential to make it big. It is not that she cannot: she simply will not.
PHOTO CREDITS: ANIESHA BRAHMA
The closest anyone has come to being an adopted daughter.

Wednesday, March 6, 2019

বিরিয়ানি


সাধারণতঃ আমি হাবিজাবি জায়গা থেকে ছবি ঝাড়ি, কিন্তু এক্ষেত্রে ফোটোগ্রাফর আমার চেনা, দেবযানী চট্টোপাধ্যায় আলম। জিভে জল না এলে জানাবেন।
মূল গল্প: Taste
লেখক: Roald Dahl
অনুবাদ নয়, “ছায়া অবলম্বনে

------

দুটো কথা অগ্রিম জানিয়ে রাখি:
১) এখানে কিছু সংস্থা (রেস্তরঁও তো সংস্থাই, না?) নিয়ে লিখেছি। যা লিখেছি সম্পূর্ণ, সর্বৈব কাল্পনিক। কেউ রেগে যাবেন না বা কষ্ট পাবেন না প্লিজ, একেবারেই বানিয়ে লিখেছি। আর যাদের কথা লিখেছি (বিশেষতঃ আর্সালান) তারা আমার খুব নিজের, সুযোগ পেলেই তাদের প্রডাক্ট ব্যবহার করি।
২) আমি অনেকদিন কলকাতার বাইরে। কাজেই কলকাতা নিয়ে যা যা লিখেছি তার অনেকটাই স্মৃতির ওপর নির্ভর করে। ভুল হলে গালাগাল দেবেন না, কারণ ক্ষমা পরম ধর্ম ইত্যাদি।
নিন, এবার পড়ুন।

------

“অসম্ভব!” চিৎকার করে উঠলেন অতীন্দ্রমোহন।

খানিকটা থতমত খেয়ে গেলেন মিলন গুপ্ত। “বলছ?”

“আবার না তো কী? অসম্ভব!”

“আর যদি করে দেখাতে পারি?”

“যদি করে দেখাতে পার মানে? এ একটা কথা হল?”

“কিন্তু সত্যিই পারি তো, পারলে বলব না?” খানিকটা মিনমিন করেই বললেন মিলন গুপ্ত।

“তুমি ইয়ার্কি মারছ?”

“না না, দেখ, আমি বাজি ধরতে রাজি আছি।”

“বাজি?”

*

অতীন্দ্রমোহন আর মিলন গুপ্ত অনেকদিনের প্রতিবেশী ছিলেন। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, ট্রাম্প-ওবামা, ইলিশ-চিংড়ি নিয়ে ধুন্ধুমার লেগেই থাকত দু’জনের মধ্যে।

তারপর, ঐ বছরদশেক আগে মিলন গুপ্ত পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যান গুরুগ্রাম না ব্যাঙ্গালোর কোথায় একটা। এখন সেখানেই থাকেন, কালেভদ্রে কলকাতা আসেন। বিপত্নীক, ছেলেমেয়ে নেই। অনেকদিন পর সম্প্রতি আবার দেখা হয়েছে অতীন্দ্রমোহনের সঙ্গে। আজ সেই নেমন্তন্ন খেতেই এসেছিলেন মিলন গুপ্ত।

দিব্যি চলছিল ক্রিকেট-ফুটবল-রাজনীতি-সাহিত্য নিয়ে। বাদ সাধল বিরিয়ানি।

আসলে বিরিয়ানির ভক্ত দু’জনেই। ঝগড়াটা আর্সালান-শিরাজ নিয়েও নয়, কারণ সেখানেও মতবিরোধ নেই। দু’জনেই নির্ভেজাল আর্সালান সমর্থক, যদিও অন্যত্র যেতেও কোনও আপত্তি নেই। ইন ফ্যাক্ট, অতীন্দ্রমোহন সাধারণতঃ একবার আর্সালান, পরের বার অন্য কোথাও – এই থিওরিতে বিশ্বাসী। তাতে নতুন রেস্তরঁ চেনাও হয়।

সমস্যাটা হল, মিলন গুপ্ত দাবি করে বসলেন যে তিনি একটা ভাত খেয়ে বলে দিতে পারেন বিরিয়ানি কোন্‌ দোকানের। সেখানেই শেষ নয়। ফ্রিজে বিরিয়ানি থাকলে তার থেকে কয়েকটা ভাত খেয়ে তিনি বলে দিতে পারেন কবে কেনা হয়েছিল, এমনকী সকালে না সন্ধ্যেতে।

অতীন্দ্রমোহন স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাস করেননি।

আর সেই থেকেই চলছে গত একঘণ্টা।

*

“বাজি?”

“কীসের বাজি?”

চশমাটা মুছে ব্যাকপ্যাকটা হাতে নিলেন মিলন গুপ্ত। তারপর চেকবই আর কলম বের করলেন: “এ-টি, তারপর আই না ডবল ঈ?”

নিজের অজান্তেই বানানটা বলে দিলেন অতীন্দ্রমোহন। তারপর টাকার পরিমাণটা দেখে চমকে উঠলেন।

এত টাকা একসঙ্গে তিনি জীবনেও দেখেননি।

মিলন গুপ্ত জিতলে অবশ্য এ চেক পাবেন না অতীন্দ্রমোহন। সেক্ষেত্রে চেক থেকে যাবে মিলন গুপ্তর কোটের পকেটেই।

নাঃ, ব্যাপারটা হালকাভাবে নেওয়া যাবে না আর।

“আর যদি পারি?”

“তোমার সত্যিই মনে হচ্ছে তুমি পারবে?”

“পঞ্চাশ লাখ টাকা, অতীন। তোমার মনে হচ্ছে আমি নিশ্চিত না হয়ে বাজি ধরছি?”

“না, তা নয়, মিলন – কিন্তু, কিন্তু... ধর তুমি জিতলে, তাহলে?”

“তাহলে শ্রেয়া।”

*

“আমি বুঝতে পারছি না তুমি কিছু বলছ না কেন। তোমার কিছু মনে হল না যখন লোকটা তোমাকে এই কথা বলল?”

“পঞ্চাশ লাখ টাকা তুমি জীবনে কখনও দেখেছো শ্রেয়া?”

“তোমার লজ্জা করছে না এটা জিজ্ঞেস করতে?”

“দেখ শ্রেয়া। তুমি নিজেও জান যে এটা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি ভেবে দেখ কী বলছে। কিন্তু তুমি ভাবতে পারছ? পঞ্চাশ লাখ টাকা।”

“লোকটা বাইরেই বসে আছে?”

“হ্যাঁ।”

“আজকেই খেলবে?”

“হ্যাঁ। ও আজকেই চাইছে। আমি বলে ফেলেছি ফ্রিজে বাসি বিরিয়ানি আছে, সেটাই খেয়ে দেখবে।”

“প্যাকেটটা ফেলে দিয়েছিলে? কোনওভাবে ডাস্টবিনে দেখে ফেললে?”

“না না, আমি নিজের হাতে ফেলে এসেছি আজ। দেখার চান্স নেই।”

“তাহলে বলছ ও নিজে স্রেফ খেয়ে বলে দেবে কোথায় কবে কখন? সে আবার হয় নাকি?”

“সেটাই তো!”

*

“তুমি নিশ্চিত যে ও পারবে না?”

“হান্ড্রেড পার সেন্ট।”

“ভাল করে ভেবেছ তো?”

“তুমি ভাবনি?”

“আমরা হেরে গেলে কী হবে বুঝতে পারছ, অতীন?”

“আমি জানি, শ্রেয়া। তুমি বল, হ্যাঁ বলব নাকি না?”

“পঞ্চাশ লাখ টাকা তো। অনেক টাকা।”

*

নিয়ম মোটামুটি এইরকম। একটা থালায় গুনে গুনে পাঁচটা ভাত রাখা। মাইক্রোওয়েভে গরম করে দিতে চেয়েছিলেন অতীন্দ্রমোহন, কিন্তু মিলন গুপ্ত বারণ করেছেন। তাতে নাকি ফ্লেভর নষ্ট হয়ে তাঁর বুঝতে অসুবিধে হতে পারে।

রেস্তরঁর নাম, তারিখ, সময় লিখে একটা কাগজ উলটে রেখে তাতে পেপারওয়েট চাপা দিয়ে রেখেছেন অতীন্দ্রমোহন। মিলন গুপ্ত নিজের উত্তর জানানো মাত্র কাগজ মিলিয়ে দেখবেন দু’জনে।

হাত ধুয়ে চোখ বন্ধ করে প্রথম ভাতটা মুখে দিলেন মিলন গুপ্ত। কামড় দিলেন না। জিভের ঠেলায় এগালে-ওগালে করতে লাগলেন

“এটা শহরের বিরিয়ানি, জানো অতীন। ধুলোর যে ফ্লেভরটা আছে সেটা আর্বান, সাবার্বান নয়। কিন্তু শহরের কোথাকার? খিদিরপুর? চিৎপুর? দক্ষিণে? পার্ক সার্কাস? মল্লিকবাজার? নিউ মার্কেট? না, না, এত সহজ নয়... ভাবতে হবে...”

“নিউ মার্কেটের আশেপাশে ঐ নিজাম-আমিনিয়ার ওখানটা একটু অন্যরকম গন্ধ, জানো তো অতীন,” দ্বিতীয় ভাতটা মুখে চালান করে দিয়ে বললেন মিলন গুপ্ত। “আসলে নিউ মার্কেটের ব্যাপারটাই আলাদা, পুরোনো বাড়ি নতুন জামা মিলিয়ে হাওয়ায় একটা অদ্ভুত গন্ধ লেগে থাকে। নিজামের ভেতরে তো পর্দা, সেখানে পরতে পরতে ময়লা, তার একটা আলাদা গন্ধ হয় জানো তো, এটা সেটা নয়। আর আমিনিয়ার ফির্নির ধারেকাছে যাই রাখো স্বাদ বদলে যাবেই। তোমরা বুঝবে না, কিন্তু আমি জানি।”

“খিদিরপুরও নয়, ইন্ডিয়া রেস্তরঁর বিরিয়ানি একটু শুকনো, আর মশলা একটু আলাদা। চর্বি কম দেয় ওরা,” তৃতীয় ভাতে মনঃসংযোগ করলেন মিলন গুপ্ত। “রয়্যালও নয়, কারণ ওদের রান্নাঘরের সবাইকে আমি চিনি, তার ওপর ঐ পাড়ায় একটু কন্সেন্ট্রেট করলেই পানের গন্ধ পাবে। জ্যাম জ্যামও নয়, কারণ বীফের পাশে রান্না হয়নি। না না, এটা এদিককার, শিরাজ বা রহমনিয়া বা আর্সালান, আর তুমিও তো এদিকটাই প্রেফার কর, তাই না?”

“এবার প্রশ্ন হল, শিরাজ না রহমনিয়া না আর্সালান?” চতুর্থ ভাতটাও তুলে নিলেন মিলন গুপ্ত। “গড়িয়াহাট, বাইপাস, হাসপাতাল, মাঠ, আবার পার্ক্সট্রীট-থিয়েটার রোড, সবরকম গন্ধ একসঙ্গে – কোথায় হয়? পার্ক সার্কাস, তাই না? আর্সালান, এই বিরিয়ানি আর্সালানের, ফ্রিজে ছিল। আমি জানি আর্সালানের। কিন্তু কবেকার?”

শ্রেয়ার হাত কেঁপে উঠল। সিগারেট ধরাতে গেলেন অতীন্দ্রমোহন, কিন্তু চিৎকার করে উঠলেন মিলন গুপ্ত। “তুমি এইভাবে জিততে চাইছ অতীন? সিগারেটের গন্ধে ফ্লেভর চলে যাবে না?”

“না না, আমি এতকিছু ভেবে...”

“দাঁড়াও!” রীতিমত গর্জন করে উঠলেন মিলন গুপ্ত। প্লেট ততক্ষণে খালি। “আমি জানি ও’দিকে কীরকম পলিউশন হয়, এত কম কেন? সোমবার হতে পারে, কারণ আগের দিন ছুটি থাকে, সোমবার দুপুরের কী? না না, দাঁড়াও, এটা আমার উত্তর নয়। সোমবার দুপুরে তুমি কেন বাড়িতে বিরিয়ানি অর্ডার করতে যাবে? সোমবার সন্ধ্যেবেলা, কিন্তু... না, এটা অন্যরকম ধোঁয়ার গন্ধ তো, গাড়িগুলো এক জায়গায় আটকে ছিল, তার মানে প্যাক যখন হচ্ছিল তখন জ্যাম ছিল। এখন তো ওদিকে অত জ্যাম হয় না, তাহলে কেন? ওঃ, বুঝেছি!”

পকেট থেকে মোবাইল বের করলেন মিলন গুপ্ত। ফেসবুকে তিন-চারটে সার্চ, তারপরেই ফোন রাখলেন টেবিলে। “মা ফ্লাইওভার বন্ধ ছিল, দেখ, কলকাতা পুলিশের পেজ বলছে। আজ সকালে খুলেছে।”

“আর্সালান, সোমবার সন্ধ্যেবেলা, মানে গতকাল সন্ধ্যেবেলা অতীন। এবার দেখি কাগজটা।”

“শ্রেয়া, তুমি ভেতরে যাও।”

“অতীন, কাগজটা দেখাও।”

*

অতীন্দ্রমোহনের অপেক্ষায় বসে থাকেননি মিলন গুপ্ত। কাগজটা উলটে দেখে মিলিয়ে নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। পকেটের চেকটা ছিঁড়ে ফেলেন পরমুহূর্তেই, অতীন্দ্রমোহন আর শ্রেয়ার চোখের সামনেই।

শ্রেয়ার নতুন ফোন নম্বরটা চেয়ে নিয়েছিলেন। ও না করেনি। করার উপায় ছিল না।

শ্রেয়ার ওপর বরাবর চোখ ছিল তাঁর। স্ত্রী মারা যাওয়ার আগে থেকেই। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারেননি। হয়ত পারতেনও না যদি বুদ্ধিটা মাথায় না খেলত।

তবে প্ল্যানটা ঐ দেখা হওয়ার দিন থেকেই করছেন। ঐদিনই চেক করে নিয়েছিলেন তিনি যে অতীন্দ্রমোহন তাঁদের ক্লায়েন্ট।

আর ক্লায়েন্টের অর্ডার ট্র্যাক করা? সে তো জোম্যাটো রিজিওনল হেডের কাছে জলভাত।

2 comments:

Followers