অনেকদিন ধরে লিখব-লিখব করেও নানা কারণে এটা লেখা হয়ে ওঠেনি।
প্রথমে মাছের বাজারের ব্যাপারটা বলি। আমি মূলতঃ তিনটে জায়গা থেকে
মাছ কিনি:
-
বাড়ির কাছের একটা মাছের বাজার। এখানে মূলতঃ মরাঠিরা যায়। এখানে
সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়, যা ওরা অসম্ভব তৎপরতার সঙ্গে কাটারি দিয়ে কাটে। “বাঙালি মাছ” বলতে পাওয়া যায় লোটে (বম্বিল) আর আমুদি (মান্ডেলি)। আমি সবরকম
মাছ তৃপ্তি করে খাই, কিন্তু আমি ভালবাসলেও আঁশটে গন্ধ বাড়ির সবার মুখে রোচে না।
-
আইআইটির উল্টোদিকের বাজার। এটা বাঙালিদের আখড়া (মাছওয়ালাও
বাঙালি)। এটা একটু দূরে হলেও কলকাতা থেকে মোটামুটি অনেক মাছই আসে।
-
বিগ বাজার। এটা একটু কাছে। এখানে রুই-কাতলা-পারশে তো পাওয়া
যায়ই, ভেটকি-পাবদা-ট্যাংরা দিব্যি পাওয়া যায়, তবে আড়-চেতল-মৌরলা-কাজরী
পাওয়া যায় না। বাড়তি সুবিধে হল এটা মলের মধ্যে, কাজেই সিনেমা দেখে বাজার করে ফেরা
যায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই এখানে বাঙালি-অবাঙালি সবাই আসে।
মাছের প্রসঙ্গে বলি, কলকাতায় থাকতে
বাসাকে আমি কখনও সিরিয়সলি নিইনি। এখানে এসে মনে হয়েছে হয় কলকাতারটা বাসা নয়ত
বম্বেরটা। দু’টো এক মাছ হতেই পারে না। স্বাদ সম্পূর্ণ আলাদা (ভাল-খারাপ নয়; আলাদা)। তেলতেলে বড় বাসার স্বাদ অপূর্ব – তবে ঐ, যদি মাছের তেল ভাল লাগে তবেই।
কলকাতার মানুষ বম্বে ভেটকিকে যেমন তাচ্ছিল্যের
চোখে দেখে, আমার ধারণা বম্বের মানুষ কলকাতা বাসাকে নিয়ে একইরকম নাক সিঁটকোয়।
যাকগে, ঘটনায় ফিরি। এটা বিগ বাজারে।
ও হ্যাঁ, এখানে গাদা-পেটি আলাদা করে কাটার রীতি নেই, সবই ঐ চাকা-চাকা। গাদা-পেটির
জন্য আলাদাভাবে বলতে হয়; তাকে বলে বেঙ্গলি কাট।
যাকগে, আমি তো চিংড়ি ছাড়াতে
আর কিছু বেঙ্গলি কাট করতে দিয়ে টুথপিক দিয়ে ফ্রী স্যাম্পল রেশমি কাবাব খাচ্ছিলাম।
মাছ কাটা হয় আলাদা একটা ছোট ঘরে, বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে।
এমন সময় শুনি এক বাঙালি দম্পতি মাছ
কেনার চেষ্টা করছেন। বছর ষাটেক বয়স। বুঝতে পারলাম এখানে নতুন এসেছেন, কারণ “হিঁইঁইঁইঁইঁইঁইঁইঁইঁইঁ, মাছের দাম দেখেছ?”র স্টেজটা এখনও আছে। খুব সম্ভবতঃ প্রবাসী ছেলে বা মেয়ের কাছে থাকতে এসেছেন,
কারণ এই বয়সে শহর ছাড়াটা বেশ অস্বাভাবিক।
তবে হিন্দিটা, ইয়ে, আমার থেকে শুধু
না, আমার মার থেকেও খারাপ, অনেকটা আমার মরাঠির সঙ্গে তুলনীয়।
যাকগে, সেদিন কাতলার ভাল স্টক ছিল।
একটা বড়সড় গোছের কাতলা মাছ বাছলেন ওঁরা। কাতলাকে হিন্দিতে (সম্ভবতঃ মরাঠিতেও) কাতলাই বলে, তার ওপর লেবেল ছিল। দামের ট্যাগ থাকায় কাজেই একটা স্টেপ
বাঁচল। ওজনও হয়ে গেল। এবার কাটানোর পালা।
এখানে একটা কমিউনিকেশন গ্যাপ হল। মেয়েটা
যত আরতি করার মত আঙুল ঘুরিয়ে চাকা-চাকা বোঝাতে চায়, ভদ্রলোক তত ক্যারাটে চপের সাহায্যে
গাদা-পেটি বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকেন। সেখানেই শেষ নয়: পাশ থেকে ভদ্রমহিলা হাত নেড়ে তারস্বরে
গাদাপেটিগাদাপেটিগাদাপেটি র্যাপ করে চলেছেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
শেষ অবধি মেয়েটাই সমাধান করল। জিজ্ঞেস
করল, “বেঙ্গলি?”
ভদ্রমহিলা সগর্বে উত্তর দিলেন “বেঙ্গলি”।
“বেঙ্গলি কাট?”
এবার ওঁরা বেশ হকচকিয়ে গেলেন।
যাওয়াটাই স্বাভাবিক। একে “বেঙ্গলি কাট” বলছে, তার ওপর পাশের ঘরে বৈদ্যুতিক করাত।
আমার হয়ত সাহায্য করা উচিত ছিল,
কিন্তু আমি তখন বাকরুদ্ধ। হাতের টুথপিক হাতেই, সে আর মুখে উঠছে না।
কীভাবে যে বোঝা গেল তা ঠিক মনে নেই,
তবে একটা সময় দেখলাম দু’পক্ষই বুঝে ফেলল বেঙ্গলি কাট আর ক্যারাটে চপ দুটো একই
ব্যাপার।
আর তারপরেই মারাত্মক ব্যাপারটা হল।
কাটতে নিয়ে যাওয়ার ঠিক আগে ভদ্রলোক
ধেয়ে এসে চিৎকার করে বললেন “পূঁছ কি কঙ্গী চাহিয়ে।”
এটা আমার রেঞ্জের বাইরে। আমি আখের
রসের দোকানে “আঁখ কা রস দিজিয়ে” শুনেছি, “বঢ়িয়া”র বিপরীত হিসেবে “ছোটিয়া” শুনেছি, কিন্তু এটা অশ্রুতপূর্ব।
খানিকক্ষণ ভেবেটেবে একটা আন্দাজ করলাম।
বড় কাতলার ল্যাজা বেশ মোটা হয়, কাজেই |||||||| জাতীয় একটা চিরুনিগোছের চর্বিভরা
ব্যাপার থাকে, আমি বেশ ভালবাসি, নির্ঘাত ওঁদের বাড়িতেও কেউ না কেউ ভালবাসে। মাছ যেহেতু
ল্যাজ আঁচড়ায় না, আমার ধারণা সেটাই বোঝাতে চাইছিলেন।
মেয়েটার জীবনেও খুব স্বাভাবিকভাবেই
প্রথম। রুইকাতলা থাকলে বাঙালি আসবেই, কাজেই ওরা বাঙালির হিন্দি শুনে অভ্যস্ত। আমার
হিন্দি বোঝা চাট্টিখানি কথা নয়, কিন্তু দিব্যি বোঝে।
কিন্তু এটা এতই আউট অফ সিলেবাস যে
মাধ্যমিকে এলে নির্ঘাত ভাঙচুর হত।
এবার ভদ্রমহিলা ফীল্ডে নামলেন। মাছটা
বৈদ্যুতিক দাঁড়িপাল্লায় আবার শোয়ানো হল। তারপর দেখি ভদ্রমহিলা ল্যাজার ইঞ্চি ওপরে হাওয়ায়
আঙুল দিয়ে অসম্ভব গতিতে কীসব এঁকে চলেছেন। মেয়েটাও তার উত্তরে কীসব আঁকল। দু’জনেই নীরব, কিন্তু হাত চলছে ঝড়ের গতিতে। খুব ছোট টেবিলে পিংপং খেলার মত এই ডাম শ্যারাড চলল বেশ খানিকক্ষণ।
আমি হলে পূঁছ গুটিয়ে পালাতাম, কিন্তু
আশ্চর্যজনকভাবে মেয়েটা বুঝল। কী বুঝল সেই জানে, কিন্তু দেখলাম ভদ্রমহিলা বেশ সন্তুষ্ট।
দু’জনে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে মাথা নাড়লেন।
ভদ্রমহিলার হিন্দিজ্ঞান সীমিত হতে
পারে, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে উনি বিশ্বের যেকোনও প্রান্তে পছন্দমাফিক মাছ কাটাতে পারতেন।
মহীয়সী মহিলা।
আমার মাছ ততক্ষণে কাটানো হয়ে গেছিল।
শেষ অবধি দাঁড়াইনি। আশাকরি ওঁদের পাতে সেদিন চিরুনি পড়েছিল।