ডিস্ক্লেমর ১ — আমি জাতিস্মর খুব ভালবাসি এমনিতে। আমার স্বপ্ন ছিল আমি জাতিস্মর হব, হতে পারিনি। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে সিনেমা দেখা। আমি 'ওম শান্তি ওম' বারদশেক দেখেছি।
ডিস্ক্লেমর ২ — ডিস্ক্লেমর ১-এর সঙ্গে বাকি লেখাটার কোনও সম্পর্ক নেই।
ডিস্ক্লেমর ৩ — কিছু স্পয়লর আছে।
***
একটা গল্প দিয়ে শুরু করি।
আমি আমার বন্ধু অমিতাভর সঙ্গে 'জাতিস্মর' দেখতে গেছিলাম। সিনেমা শেষ হতে অমিতাভ বলল "শেষে সুমনকে এনে সৃজিৎ চীটিং করেছে।"
কী চীটিং? না, যেটুকু যা খারাপ লাগার সম্ভাবনা ছিল, সুমনকে এনে তার ছিটেফোঁটাও আর রইল না। সিনেমাটা ভাল লাগা ছাড়া আর বিশেষ অপশন রইল না। কিন্তু মূল সমস্যা হল, সুমন শুধু শেষটুকুতে নয়, সিনেমা জুড়ে হৈহৈ করে ঘুরে বেরিয়েছেন। ভদ্রলোক বেশ দাপটের সঙ্গে ফিরে এসেছেন।
সে যাক্, মূল কথায় আসি। যীশুকে অবশেষে মানিয়েছে (যদিও গুজরাতি উচ্চারণটা কেমন যেন ঠেকল; সেটা কি আমি গুজরাতি বুঝি না বলে?); স্বস্তিকাকে আর কিছু না লাগুক, স্মার্ট লেগেছে; কিন্তু বাকিরা?
তিনটে মারাত্মক কাস্টিংএর কথা না বললেই নয়। তমাল রায়চৌধুরীকে দিয়ে শুরু করি; আমি সিরিয়সলি ভাবিনি তমালবাবুকে এইধরনের ভূমিকায় নেওয়ার কথা কেউ ভাবতে পারে, কিন্তু কী অদ্ভুত সাবলীল পার্ফর্মেন্স! অনন্যা চট্টোপাধ্যায় (যাঁর প্রতি আমার ঈষৎ দুর্বলতা আছে) সম্পর্কে বলে জায়গা নষ্ট করতে চাই না; লাস্য, কুহক — এইজাতীয় কথা বইয়ে পড়েছি, কিন্তু বাংলা সিনেমায় বোধহয় এই প্রথম দেখলাম (এমনি এমনি ব্যথা হয়নি)।
বাকি রইলেন খরাজ মুখোপাধ্যায়। খুব অল্প কথায় বলতে গেলে, শুধুমাত্র ঐ একটা দৃশ্যই প্রসেনজিৎ ডমিনেট করতে পারেননি। বাকি সিনেমটা কুশল হাজরা আর হেন্সম্যান অ্যান্টনির; কিন্তু ঐ পাঁচটা মিনিট আদ্যোপান্ত ভোলা ময়রার, সেখানে বাকি কারুর প্রবেশ নিষেধ।
প্রসেনজিৎ নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। এটা এই দুটো যে আজ অবধি সেরা অভিনয়, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ঋতুপর্ণ মারা যাওয়ার পর প্রসেনজিতকে আর কেউ ব্যবহার করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ ছিল, কিন্তু এবার পুরোপুরি ঘুচে গেল।
বাকি রইল টেকনিকল কচ্কচি। সেট, চেক্; কস্ট্যুম, চেক্; চিত্রনাট্য, চেক্; সংলাপ, চেক্; গান, বিশেষ বুঝি না, তাও চেক্, কারণ সিনেমার বাইরেও শুনেছি; কোরিওগ্রাফি, চেক্; ক্যামেরা, সীমিত জ্ঞান অনুযায়ী চেক্; রিভিউ শেষ। খুব ভাল সিনেমা, সবই বেশ ভাল, অনেক হাততালি, স্ট্যান্ডিং ওভেশন, মুখে ফুলচন্দন পড়ুক্, আরও নানারকম যা যা হয়।
***
এ তো গেল রিভিউ। আমি নিশ্চিত যে আজ অবধি 'জাতিস্মর'এর যতগুলো রিভিউ হয়েছে তার মধ্যে এটা অন্যতম খাজা রিভিউগুলোর একটা। কিন্তু বস্, "সিনেমা কেমন লাগল?"র উত্তরে তো স্রেফ রিভিউ লিখলে চলে না - অন্যান্য দু-একটা কথাও বলতে হয়।
জাতিস্মর ব্যাপারটা আমার কেন ভাল লাগে, এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি; জাতিস্মরের কন্সেপ্টটার মধ্যে তিনটে বেশ কঠিন জিনিস জড়িত — মৃত্যু, স্মৃতি, আর সময়। কীভাবে?
মৃত্যুটা বোঝানোর মধ্যে যাচ্ছি না। মৃত্যু জাতিস্মরের ডেফিনিশনের অন্তর্গত, ওটা বাদ দিয়ে হয় না। ওকে রাখতেই হবে। স্মৃতিও ঠিক তাই।
সময়ের ব্যাপারটা একটু ট্রিকি। আমি আছি এই জন্মে, কিন্তু পূর্বজন্মের ফ্ল্যাশব্যাক আসে, আর সেটা ক্রমশঃ ডমিনেট করতে থাকে। মুকুল আদৌ ইন্টারেস্ট পেত না বর্তমান জীবনে; প্রাপ্তবয়স্ক কুশল হাজরার পক্ষে কিন্তু ব্যাপারটা একটু অন্যরকম।
মুকুল বোঝেনি যে সোনার কেল্লার পেছনে ছোটাটা অর্থহীন, কারণ কেল্লাটা পেলেও সময়টাকে ফেরত পাওয়া যায় না; চন্দননগরে পৌঁছনো সত্ত্বেও অবর্ণনীয় কষ্টের উপশম না হওয়ায় কুশল হাজরার সেই উপলব্ধি হয়েছে।
কী মারাত্মক সেই উপলব্ধি! একটু একটু করে আরেকটা অস্তিত্ব আমাকে গ্রাস করছে — কিন্তু তাকে ছোঁওয়ার কোনও উপায় নেই। প্রতিমুহূর্তে পূর্বজন্মের ফ্ল্যাশব্যাক দুমড়ে-মুচড়ে-নিংড়ে শেষ করে দিচ্ছে, কিন্তু ফেরা সম্ভব নয়। সেই একই জায়গা, একই সূর্য, একই বাতাস — কিন্তু চ্যাম্পিয়ন কবিয়াল শেষে অ্যাসিস্ট্যান্ট লাইব্রেরিয়ন? আর সেটাও যদি মেনে নেওয়া যায়, সৌদামিনী?
প্রেম কতরকমের হয়? আর প্রেমে অপ্রাপ্তি? তাইই বা কত রকমের? আমি আমার প্রেমিকাকে পেলাম না, অন্য কারুর প্রেমে পড়লাম; আমার প্রেমিকা মারা গেল, আমি কাটিয়ে যাওয়া দিনগুলোকে আঁকড়ে ধরে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিলাম, বা বড়জোর 'মূভ অন' করলাম।
কিন্তু এই যন্ত্রণা? দুজনেই ছিলাম; এখানেই; দুজনেই মারা গেছি, তুমি আগে, আমি পরে। তারপর? সব শেষ, তাই না? তারপর যদি আমি ফিরে আসি, সেই একই জায়গায়, আর এসে দেখি তুমি নেই? সবথেকে বড় কথা, তুমি যে নেই তার কারণ এই নয় যে তুমি চাও না, বা তুমি চলে গেছ, বা এমন কী তুমি মারা গেছ। এগুলো হয়।
এখানে ব্যবধানটা আরও বড়।
সময়ের ব্যবধান।
আমরা ছিলাম। দু'শো বছর আগে। আজ, দু'শো বছর পর আমি একা আছি। তুমি নেই। এই ব্যবধান মৃত্যুর নয় যে আমি মরলে সমস্যার সমাধান হবে; সময়ের দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান পেরোব কীভাবে? এইখানে তুমি ছিলে, দু'শো বছর আগে, এইখানে, আমি তোমাকে দেখেছি, পেয়েছি, তোমার সঙ্গে মিলিত হয়েছি, আর আজ — আজ হাজার মাথা খুঁড়ে মরলেও দেখতে পাব না।
ভয়ঙ্কর না? স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে তোমাকে, কিন্তু হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারছি না; চোখের সামনে দেখছি আমি বাড়ি ফিরলে তুমি জল এনে দিচ্ছ, কিন্তু ফিরতে হচ্ছে নোনাধরা বাড়ির ম্যাদামারা বাল্বের জগতে, একা।
একা।
হয়ত দেখতে পাচ্ছি তুমি জড়িয়ে ধরছ, কিন্তু ধরছ না। তোমার হাসি দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু তোমাকে আদর করতে পারছি না। তোমার কান্না দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু ঠোঁট দিয়ে চোখের জল মুছে নিতে পারছি না।
কিন্তু তাও নয়। সবথেকে বড় অসহায়তা এগুলোর একটাও নয়। সেটা আরও গভীর, আরও মর্মস্পর্শী।
ভাবি একটু? আমি কাউকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসি; আমি জানি কখন কীভাবে তার মৃত্যু হবে; আমি জানি কী কী না করলে তার মৃত্যু আটকানো যেত; কিন্তু তাও আমি বারবার দেখতে থাকব নিজেকে, একই ভুল করতে, আর প্রতিবার আমাকে এসে তার মৃতদেহ দেখতে হবে; আমি না পারব তার মৃত্যু আটকাতে, আর না পারব মৃতদেহ না দেখে থাকতে।
বারবার। কতটা সহ্যশক্তি লাগে বারবার এটা দেখতে? এটা দেখা আটকানোর প্রত্যেকটা চেষ্টা ব্যর্থ হতে? পারতাম? জানি না। পারতাম না।
আর তাই কুশল হাজরাকে বুঝলাম। আগে দেখেছিলাম স্ক্রিনে; দু'তিনদিন লাগল ভেতরে ঢুকে বুঝতে। আর তখন বুঝলাম কষ্ট ছাড়াও আরেকটা দিক আছে, আশার, আনন্দের।
একবার সৌদামিনীকে পাইনি, দ্বিতীয়বার তুমি মহামায়া হয়ে ফিরেছ কিন্তু তোমাকে পাওয়া হবে না — কিন্তু পরেরবার? তৃতীয়বার? আরও আগে অনেক অনেকবার হয়ত তুমি এসেছিলে — আমার মনে নেই সেইসব জন্মের কথা — কিন্তু এর পরেরবার? বা তার পরেরবার? অসহায়তা যেমন আছে, তেমন একটা অন্ধ আশাও তো আছে — একবার তো পাব? কখনও? সময়কে হারিয়ে দু'জনে এক হব? একবার তো অন্ততঃ তুমি জননী হবে, আর আমি পিতা?
আর এই অসহ্য কষ্ট আর বুকভরা আশার টানাপোড়েনেই সৃজিৎ বাজিমাত করেছে। সৃজিৎ সময়কে বুঝেছে। আর আমাকে বুঝতে বাধ্য করেছে। আর বেশ ক'দিন ধরে ভাবিয়ে ভাবিয়ে আমার প্রাণ বের করে দিয়েছে। তাই যত দিন যাচ্ছে কুশল হাজরাকে একটু একটু করে বুঝছি।
স্ট্যান্ডার্ডটা পড়তে দিস্না বস্।