"বংপেন" নামটা প্রথম শুনেই আমার গা-পিত্তি জ্বলে গেছিল। একে তো "বং" কথাটা সহ্য হয় না (যদিও গ্রেটবং সেটার মাত্রা খানিকটা কমিয়েছে); তার ওপর ২০১৩র বইমেলায় একটা টপ্লেস লোকের ছবি দেখে বইটা কেনারও বিশেষ প্রবৃত্তি হয়নি।
আবার অ্যামাজন থেকে ঝেড়েছি! |
কিন্তু তারপর বংপেনের সঙ্গে, মানে, ব্লগটার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হল। চোখের সামনে দেখতে থাকলাম ব্লগার থেকে তন্ময়ের লেখক হয়ে ওঠা। ২০১৩টা ছিল ওর ওয়াটারশেড ইয়ার। আর তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, ২০১৪র বইমেলায় বইটা কিনতেই হবে; না কিনলে জীবন বৃথা।
তন্ময়ের লেখার বৈশিষ্ট্য কী? তন্ময়ের সেন্স অফ্ হিউমর অসাধারণ, কিন্তু তার পরিচয় মেলে সোশল নেটওয়র্কে (মূলতঃ ইংরিজিতে), বইয়ে নয়। বইয়ে তন্ময়ের হিউমরে একটা ঈর্ষণীয় পরিমিতিবোধ আছে: হিউমর ব্যাপারটা সবার আসে না, কিন্তু তন্ময়ের সেটা সহজাত; কিন্তু সবথেকে বড় ব্যাপার হল, গল্পের খাতিরে হিউমর কমাতে ও রাজি, কিন্তু উল্টোটা নয়। কোনওরকম বাড়াবাড়ি নেই।
কিন্তু এটাও তন্ময়ের আসল গুণ নয়। ছেলেটা বাচ্চা হলে কী হবে, লেখার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম মায়াবী দিক আছে, আর আছে একটা মারাত্মক মন-খারাপ-করা কষ্টে-দুমড়ে-দেওয়া মধ্যবিত্ত বাঙালিয়ানা; আবার আছে আরেকটা কড়া হাতের থাপ্পড়, যেটা বারবার ঘাড় ধরে ভাবতে বাধ্য করে, একটা জঘন্য অপরাধবোধে দুমড়েমুচড়ে দেয় ভেতরটা। নিজেকে কোনও না কোনও চরিত্রের মধ্যে খুঁজে পেতে বাধ্য হবেন আপনি; অন্যের থেকে লুকোতে পারবেন নিজেকে তখন — কিন্তু নিজের থেকে?
স্থান-কাল-পাত্র কথাটা আমরা দুমদাম বলে থাকি, কিন্তু তন্ময় ব্যাপারটা যত সুন্দরভাবে বুঝেছে ততটা বুঝিনা। শহর থেকে মফঃস্বল থেকে গ্রাম, অতীত-বর্তমানের দুটো-তিনটে প্রজন্ম, আর পাত্রের ব্যাপারটা তো ছেড়েই দিলাম; অদ্ভুত অনায়াস ট্রান্সিশন একটা থেকে আরেকটায়।
কিন্তু এসব যদি নাও থাকত তাহলেও তন্ময়ের লেখা একইরকম উপভোগ্য হত, কারণ বাংলা ভাষায় এত ভয়ংকর সুন্দর (এটা কথার কথা নয়; "ভীষণ সুন্দর" বলতে চাইনি; ভয়ঙ্কর অ্যান্ড/অর সুন্দর বলতে চেয়েছি) ছোটগল্প খুব কমই লেখা হয় আজকাল। তর্তরে মেদহীন ভাষা, চমৎকার চরিত্রায়ন, সাবলীল লেখার ভঙ্গি, আর একটা পেট-খালি-করে-দেওয়া ক্লাইম্যাক্স। এই বইটায় ছোটগল্পের সংখ্যা কম (কিন্তু রম্যরচনাগুলো আছে, যেগুলো না পড়ে বাঙালি সাহিত্যপ্রেমী বলে নিজেকে পরিচয় দেওয়ার মানেই হয় না), কিন্তু আশাকরি তন্ময় আর রোহণ "বংপেন ২"এ গল্পের সংখ্যা অনেক বেশি বাড়াবে।
রোহণকে আরেকটা ব্যাপারে ধন্যবাদ। তন্ময় ফেসবূকে আর টুইটারে নানান্ অসাধারণ (বলেছিলাম না?) স্টেটাস মেসেজ দেয়, যেগুলো হারিয়ে যায়। রোহণ সেগুলোর থেকে বাছাই করে কয়েকটা বইয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে। হোক্ ইংরিজি, কিন্তু ভাল লেখা তো!
***
অভিযোগ: রোহণ, এই বইটায় ছবি কম কেন?
***
বোনাস প্রাপ্তি: তন্ময়ের সাক্ষাৎকার। পড়েই দেখুন, বেশ জমাটি ছেলে।
অভিষেক: একদম ব্লগ থেকে তুলে প্রশ্ন করছি: মুখার্জী তন্ময়? সে কে হয়?
তন্ময়: মন দিয়ে চাকরি করি। ঘরকুনো। বিরিয়ানি সত্যিই ভালোবাসি। কলকাতার প্রতি সিনসিয়ার ভালো লাগা আছে তবে আদিখ্যেতা নেই।বাথরুম গাইয়ের ব্যাপারটা নিজেকে ঠাট্টা করে বলিনি; আমি আন্তরিক ভাবে বিশ্বাস করি শাওয়ারের তলায় আমার কণ্ঠস্বর আর পাঁচটা বাঙালির চেয়ে বেশি খোলতাই হয়। ইন্টারনেট আমাদের ক্ষতির চেয়ে উপকার অনেক বেশি করে; এই তথ্য আমি প্রাণপণ পুশ করি। আর আমি বাংলা ব্লগার।
অভিষেক: হঠাৎ বংপেন নাম কেন?
তন্ময়: বাঙালি ইডিওসিঙ্ক্রেসিগুলো নিয়ে ব্লগ করাই ছিল উদ্দেশ্য। কাজেই ব্লগের নামে বাঙালি বা বেঙ্গলি গোছের কিছু থাকবে, সেটা ভেবে নিয়েছিলাম। আর ব্লগ যখন শুরু করি তখন পোস্ট করতাম রোমান হরফে বাংলা লিখে; সেই রোমান হরফে বাংলার মেজাজটা এই "বং" শব্দটা বেশ সহজে ক্যাপচার করেছিল। এ ছাড়া ব্লগের ইউআরএলএ "বাঙালি"র বদলে "বং" ব্যবহার করাটা ইকনমাইজিংএ সাহায্য করেছিল।
"বং" ব্যাবহারের আরও একটা স্পষ্ট কারণ আছেই। যা দেখে ব্লগ ব্যাপারটার আদত ব্যাপ্তি মালুম হওয়া; গ্রেট বং ডট নেট। তোমার ব্লগ থেকে তুলে বলতে গেলে “ইট্ অল্ বিগ্যান উইথ হিম”। সহজ অনুপ্রেরণা।
পেন কেন জুড়লাম মনে নেই। "বং"এর পর অনেক সাফিক্স হয়তো গূগ্ল অগ্রাহ্য করেছিল “অলরেডি টেক্ন্” বলে। পেন ছিল। এমন পাতি কারণেই "বংপেন"।
অভিষেক: মলাটের ভদ্রলোক কে? আলাপ করেছিস্? উনি কিন্তু বইয়ের কাটতি বাড়িয়ে দিয়েছেন!
তন্ময়: মলাটের কনসেপ্ট একান্তই রোহণের (প্রকাশক-বাবুটি)। ভদ্রলোক সম্ভবত কুমোরটুলির কারিগর। ওনাকে ঘিরে আমার অনেক অকূলপাথার চিন্তা-ভাবনা। অনেক বেওয়ারিশ-রোম্যান্টিক সব আইডিয়া আছে ওঁর ম্যাদামারা অথচ দাবীময় ইমেজ ধরে। আমি অনেক পোস্ট লেখার চেষ্টা করি যেখানে প্রোটাগনিস্টের মুখ আমি ওঁর মুখের আদলে কল্পনা করি। অ্যাট সাম লেভেল, উনি আমার সুচিত্রা সেন। যাকে শুধু গ্ল্যামারের ফ্রেমে আঁটা যায়, কিন্তু যার পাশে বসে চা-বিস্কুট খাওয়া চলে না।
অভিষেক: বইয়ে তো নেই, কৃতজ্ঞতার ব্যাপারটা এখানেই সারবি?
তন্ময়: একটা উৎসর্গপত্র বইতে রেখেছি। টু মাই ফ্রেন্ড্জ। যাঁদের সাথের গপ্প-আড্ডায় আমার গ্যাঁজানোর দম বেড়েছে। তবে যদি একজনের কথা নির্দিষ্ট ভাবে বলতে হয় তবে সে আমার স্কুলের সহপাঠী সুহেল ব্যানার্জি। আমি আদৌ কোনও রকম লেখালিখিতে কখনোই ছিলাম না। ২০০৬ পর্যন্ত তো নয়ই। কেন ওর মনে হয়েছিল যে আমি ব্লগ করতে পারবো তা ওই জানে। ইন ফ্যাক্ট ব্লগ ব্যাপারটা ওই আমায় প্রথম খোলসা করে বলে। স্পেসিমেন হিসেবে আমায় পড়ায় অর্ণব রায়ের ব্লগ। সুহেলের আইডিয়াতেই ব্লগিংএর শুরু। প্রাথমিক ভাবে ব্লগের সাবজেক্টও ওরই প্রায় ঠিক করে দেওয়া; বাঙালিজ্ম। সুহেলের মনে হয়েছিল বাংলা নিয়ে আমি ব্লগোপযোগী হালকা লেখা নিয়মিত লিখতে পারবো। সেই থেকেই বংপেন শুরু ২০০৭এ। আমার ব্লগের প্রথম নিয়মিত পাঠকও ওই সুহেল। তবে ও এত কাছের বন্ধু, “কৃতজ্ঞতা” জানালে প্যাঁক দিতে পারে।
এছাড়া লেখা ও লেখার মাধ্যম নিয়ে অনেক মানুষ নিয়মিত ফিডব্যাক দিয়েছেন। যেমন ধর রোহণ বলেছিল “ইংরেজি ফন্টে লিখ না, ইউনিকোডে এসো”। এক মুখুজ্জ্যেবাবু আমায় অভ্র ধরিয়েছিলেন। লেখা দরকচা মেরে গেলে অনেকে স্টাইলের ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন, নতুন আইডিয়া যুগিয়েছেন, টিপ্স দিয়েছেন। আমি একটু একটু করে শিখছি।
অভিষেক: কবে থেকে ভাবতে শুরু করলি যে তোর বই বেরোতে পারে?
তন্ময়: বইয়ের আইডিয়া সম্পূর্ণ ভাবে রোহণের। ব্লগ থেকে যে বই হতে পারে সে ধারণা আমার কোনও দিন ছিলনা।বরং আমি যথেষ্ট সন্দিহান ছিলাম এ ব্যাপারে। ইন ফ্যাক্ট “ব্লগের সাহিত্য”; এ হুজুগটাই একান্ত ভাবে ওর।
অভিষেক: ছোটগল্পটা তোর বেশ ন্যাচারালি আসে। সংকলন লেখার কথা ভেবেছিস্?
তন্ময়: আমি যে কোনও লেখা ব্লগপোস্ট ভেবে লিখি। একটা যে কোনও বিষয় আগে ভেবে নিই। কখনও সেই বিষয়ে সোজাসাপটা লেখা লিখে দি। কখনো প্লট ফেঁদে সে বিষয়টার সম্বন্ধে আমার মতামত বের করে আনার চেষ্টা করি। অর্থাৎ আলুসেদ্ধ কেন আমার ভীষণ ভালো লাগে তা নিয়ে সোজাসুজি প্রবন্ধ গোছের কিছু না লিখে, একজন মানুষ আলু সেদ্ধ খেতে খেতে কেমন মজে গেলেন তেমন একটা ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করি। বছরখানেক ধরে বিশেষ ফোকাস নিয়ে প্লট ধরে লেখার চেষ্টা করছি। কিন্তু লেখাগুলো মূলত একটা ব্লগ-বিষয় ভিত্তিক; যেমন শীত কেন পড়ছে না, কবিতা আর গোয়েন্দাগিরির পার্থক্য ইত্যাদি। লেখাগুলো প্লট-নির্ভর নয়। সে লেখাগুলোর দৈর্ঘ্যও খাটো। এবং সেগুলো লেখা মাত্রই ব্লগে পোস্ট করে দেওয়ার দুর্বার চাড় আসে; কারণ ব্লগ ভেবেই সেগুলো ফাঁদা।
এত পাঁয়তারা কষলাম এইটা বলতে যে গল্প সংকলন গুছিয়ে লিখবার স্কিলসেট , ধৈর্য এবং সাহস এখনও ঠিক আয়ত্ত হয় নি। মনে হয়। তবে ইচ্ছে তো হয়ই।
অভিষেক: তোরা সিরিয়াসলি লিখলে বাংলা ভাষাটা ঘুরে দাঁড়াবে বুঝিস্?
তন্ময়: বাঙালি যত বাংলা লিখবে, বাংলা ভাষা তত জমাট হবে; এ বিশ্বাস আছে।
অভিষেক: প্রথম অটোগ্রাফ দেওয়ার গল্পটা বল্।
তন্ময়: আমার হাতের লেখা বীভৎস বললে সেটা কমিয়ে বলা হবে। স্রেফ আমায় ভালোবেসে পিঠ চাপড়ে দিতে যে গুটিকয় মানুষ বংপেন বইটায় আমায় সই করতে বলেছেন, তাঁদের বিভিন্ন বাহানায় ডাইভার্ট করেছি। বইটা আমার ভীষণ প্রিয়; তাঁর গায়ে হিজিবিজি দাগ দিতে মন চায় না।
অভিষেক: তুই ইংরেজি-বাংলা দুটোই সমান ভাল লিখিস্। ইংরেজিতে লেখার কথা ভেবেছিস্?
তন্ময়: আমার কনভার্সেশনল টোনে বা কথোপকথনের ভঙ্গিমায় লিখতে ভালো লাগে। সে কারণেই আমি প্রবন্ধভিত্তিক লেখা না লিখে প্লটভিত্তিক লেখার চেষ্টা করি; বিষয় প্রবন্ধের দাবী রাখলেও। মুশকিল হচ্ছে আমি ভীষণ ভাবে শহুরে বাঙালির কনভার্সেশনল টোনে অভ্যস্ত। সে কারণেই ইংরেজিতে লিখলে ক্রিস্প্ লেখায় যে মেজাজ থাকা উচিত সেটা ধরে রাখতে বেশ হিমশিম খাব বলে আমার বিশ্বাস। এমনকি নিজের বাংলা পোস্ট ইংরেজিতে অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি কয়েকবার; আউটপুটকে যথেষ্ট যুতসই মনে হয় নি।
অভিষেক: দুটো সংস্করণ তো বেরিয়ে গেল। নতুন বই কবে আসছে?
তন্ময়: ব্লগ সংকলন ? প্রথমটির আইডিয়া রোহণের ছিল। নতুন লেখা নিয়ে নতুন ব্লগ সংকলনের বিষয়ে এখনই হাতেগরম কোনও চিন্তা নেই। ইয়ে, ভারি ইচ্ছে। মানে। জেনুইন ইচ্ছে। একটা উপন্যাস লেখার। আহা, যদি পারতাম গো অভিষেক দাদা...