দুটো সিনেমা নিয়ে লিখতে বসলে আলাদা-আলাদাভাবে
লেখাই দস্তুর। ইন ফ্যাক্ট, ‘নির্বাক’
আর ‘রাজকাহিনী’ দুটোই
সৃজিতের সিনেমা, এছাড়া আর বিশেষ মিল নেই। কিন্তু দুবার লেখার
থেকে একবার লেখা সহজ, অতএব...
ডিস্ক্লেমরঃ ১৯৪৭এ রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা হত
কিনা আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করেছে। মাইরি বলছি, জানি না।
‘রাজকাহিনী’র
কথা বলি। ট্রেলর দেখে ‘রাজকাহিনী’র
ব্যাপারে একটা ভালরকম প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তারপর ফেসবুক জুড়ে মারমারকাটকাট সব রিভিউ। অব্ভিয়সলি দেখার একটা ডেসপারেট ইচ্ছে ছিল, বিশেষতঃ যেখানে শেষ দুটো সিনেমা ‘জাতিস্মর’ আর ‘চতুষ্কোণ’।
আগে ঋতুপর্ণার ব্যাপারটা সেরে নিই। আমি বরাবর
ঋতুপর্ণার ভক্ত, নব্বইয়ের
দশকেও ছিলাম, সেই ‘তীসরা কওন’এর সময় থেকে। আমি বরাবর বলে এসেছি, বাংলা বাণিজ্যিক সিনেমার
অন্ধকার যুগে (১৯৯২ থেকে, ধরা যাক্, ২০০০?)
ইন্ডাস্ট্রিকে ঋতুপর্ণা একা হাতে টেনেছিলেন। স্ক্রিপ্টের খাতিরে
অভিনয় কম্প্রোমাইজ করতে হয়েছিল, কিন্তু প্রতিভা বরাবরই ছিল,
দেবশ্রী-শতাব্দীর থেকে বেশিই। ‘দহন’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, বা ‘পারমিতার
একদিন’ নয়ত হত না।
মুশকিল হল, যতদিনে বাংলা বাণিজ্যিক সিনেমা আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, পরবর্তী প্রজন্ম এসে গেছে; ফলে ঋতুপর্ণার বাজার
পড়তে শুরু করেছে। ততদিনে ঋতুপর্ণার বয়স হয়েছে, টাইপকাস্ট হতে
শুরু করেছেন বিবাহিতা, উচ্চবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্তের
ভূমিকায়। কিন্তু দক্ষতা কমেনি, কারণ প্রতিভা কমে না।
অপেক্ষা ছিল একটা রোলের, একটা চিত্রনাট্যের। সেটাই
বেগমজান। ‘রাজকাহিনী’তে আর কে কী কী
করবে জানি না, কিন্তু কয়েকটা পুরষ্কার বাঁধা।
এর খানিকটা কৃতিত্ব অবশ্যই সৃজিতেরও, কারণ ‘বাইশে
শ্রাবণ’এ গৌতম ঘোষ, ‘চতুষ্কোণ’এ চিরঞ্জিতের এক্সপেরিমেন্ট করার আইডিয়া ওরই। বেগমজান অনায়াসে হতে পারতেন
বম্বের কেউ, শাবানা (অবিশ্যি শ্যাম বেনেগল ‘মণ্ডি’তে আগেই শাবানাকে নিয়েছিলেন, নিলে সমালোচনা অবশ্যম্ভাবী ছিল) হলে তো কথাই ছিল
না। কিন্তু সৃজিৎ ঋতুপর্ণাকে ব্যাক করেছে, আর ফ্যাস্ফ্যাসে গলা সত্ত্বেও স্রেফ অভিনয়ের জোরে ব্যাপারটা উৎরে
গেছে।
বাকিদের কথা বলতে গেলে তো পুরুষদের কথা বলতে হয়, কারণ কোঠাবাড়িতে বেগমজান ছাড়া আর
কোনও ত্রিমাত্রিক চরিত্র নেই। শাশ্বত-কৌশিক-রুদ্রনীল-কাঞ্চন-যীশুর মধ্যে একজনকে বাছা
বেশ কঠিন। শাশ্বত-কৌশিকের দৃশ্যে সংলাপ, আলো, আবহ কোঠাবাড়ির বিশৃঙ্খলার সঙ্গে অদ্ভুত সুন্দর কন্ট্রাস্ট। দুজনেই অসাধারণ,
নিজেদের স্মৃতি আর ঘৃণা মিশিয়ে। পুরো সিনেমা জুড়ে, আর বিশেষতঃ নিজেদের শেষ দৃশ্যে রুদ্রনীল, কাঞ্চন
দুজনেই অনবদ্য।
কিন্তু যীশুর কথা আলাদাভাবে বলতেই হবে। মেকআপ
বিশেষ ভাল নয় (পরচুলা জাস্ট বোঝা গেছে, অস্বস্তি হচ্ছিল), কিন্তু
অভিনয়ে পুষিয়ে গেছে। আমি যীশুর ভক্ত ছিলাম না কখনও, কিন্তু
নিজেকে ভেঙে, ঐ ঠাণ্ডা নির্মম দৃষ্টিতে, মাপা সংলাপ, হাঁটাচলা, সব
মিলিয়ে এটা নিঃসন্দেহে যীশুর শ্রেষ্ঠ পার্ফর্মেন্স।
অনেকের কোঠাবাড়ির নানান্ দৃশ্য অস্বাভাবিক লেগেছে, কিন্তু কেন? অনেকে বলেছে, বাংলার ঐ অঞ্চলে রুক্ষ জমি নেই;
হক্ কথা। জিজ্ঞেস করেছে, কোঠাবাড়িতে ঠাম্মার
ভূমিকা কী? কেন তার আশেপাশে বসতি নেই? বসতি
ছাড়া ওদের খদ্দের জোটে কীভাবে? গ্রামকে গ্রাম উচ্ছেদ হয়ে
যাচ্ছে, ব্যবসায় ভাঁটা অনিবার্য জেনেও কেন ওরা থাকতে চায়?
এর উত্তরও সিনেমাতেই আছে। কোঠাবাড়ি, বেগমজানের ‘আশিয়ানা’ তো একটা আস্ত দেশ! স্বাধীনতা চায়, নিজেদের মত বাঁচতে চায়, এইর'ম
একটা আস্ত দেশ, ছোট্ট, নগণ্য হলেও দেশ,
যার নিজস্ব নিয়ম, নিজস্ব আইন আছে! এরা তো প্র্যাক্টিকাল নয়! এখানে সবাই আবেগসর্বস্ব, সবাই শুধু একসঙ্গে থাকতে, বাঁচতে চায়, উপার্জন করতে চায়!
নিজের দেশটাকে চিনতে না পারলে কী বলব? এই কোঠাবাড়ি তো একটা ছোট্ট ভারতবর্ষ!
নিজের দেশটাকে চিনতে না পারলে কী বলব? এই কোঠাবাড়ি তো একটা ছোট্ট ভারতবর্ষ!
সমস্যা হল, এই দেশটা আমরা নিজেরাও চাই। তাই নিজেদের ভিটেমাটি
আঁকড়ে পড়ে থাকি, ছাড়তে চাই না, যেটুকু
আছে সেটুকু সম্বল করে বাঁচতে চাইঃ এটা খামোকা অস্বাভাবিক কেন হতে যাবে?
অভিযোগ? তা আছে বৈকি। আবিরের চরিত্র বেশ অপ্রাসঙ্গিক লেগেছে,
যেমন লেগেছে সমকামী দৃশ্য (কেন, সৃজিত?
দেখানোর জন্য দেখানো?)। কোঠাবাড়ির চরিত্রগুলোয়
আরেকটু ঢোকা যেত। রজতাভ বেশ ম্লান। আর এইর’ম ফ্রেমের সিনেমার
শেষ দৃশ্যে যে মানের ক্লাইম্যাক্স, যে ইন্টেন্স যুদ্ধ আশা
করেছিলাম, সেটা দাঁড়ায়নি, হয়ত সীমিত
বাজেটের জন্য, হয়ত নিম্নমানের সিজির জন্য। কোঠাবাড়ির আগুন খুব কৃত্রিম লেগেছে।
জহরব্রতকে গৌরবান্বিত করে নারীবাদকে অপমান করেছে? তা হবে হয়ত। অতশত বুঝি না। কিন্তু,
মাইরি, ‘ভারতভাগ্যবিধাতা’র সময় যখন গোটা হল কাঁদছিল, আমিও চাপতে পারিনি। যেমন
পারিনি গায়ে কাঁটা দেওয়া আটকাতে, প্রথম দৃশ্যে; এবং আরো অনেক, অনেক দৃশ্যে।
‘জাতিস্মর’ বা
‘চতুষ্কোণ’এর মত অনবদ্য সিনেমা নয় ‘রাজকাহিনী’। কিন্তু ‘রাজকাহিনী’
অসাধারণ প্রচেষ্টা, আর অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক
সিনেমা, কারণ ‘রাজকাহিনী’ ১৯৪৭এর সিনেমা নয়, ২০১৫রও সিনেমা। আর, বস্, ‘রাজকাহিনী’ ছুঁয়ে গেছে। মনে থাকবে।
যেমন মনে থাকবে বুঁচকিকে।
***
‘রাজকাহিনী’ অনবদ্য
সিনেমা নয়। আনলাইক ‘নির্বাক’। বড়
স্ক্রীনে ‘নির্বাক’ দেখার সুযোগ হল না।
হয়ত হবে।
‘নির্বাক’ বেশ
কয়েকটা সেগমেন্টের সিনেমা, তাই সেগমেন্ট বাই সেগমেন্ট এগোনো
উচিত।
প্রথম সেগমেন্টে আসি। অঞ্জন দত্তকে হাস্যকর, বীভৎস, কদাকার,
কুরুচিকর লেগেছে; জাঙিয়া-পরা অঞ্জন দত্তকে
দেখার জন্য কে সিনেমা দেখতে যাবে? একবার ভাবলাম, বন্ধ করে দিই। ভাগ্যিস দিইনি।
পরে যত এগোলো, তত বুঝলাম, অঞ্জন দত্তর
চরিত্রায়ণ, প্রতিটা দৃশ্য, সবকিছু ইচ্ছাকৃত। নার্সিসিজম যতটা সম্ভব নোংরাভাবে দেখানোটা উদ্দেশ্য ছিল। গা ঘিনঘিন করানোটা
উদ্দেশ্য ছিল। সেটা সফল।
তারপর সিনেমা যত এগিয়েছে, তত ঢুকে গেছি সিনেমার মধ্যে। যীশু
বেশ পরিমিত, সুস্মিতাকে কখনও ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। আর
ঋত্বিক, শাশ্বতকে মাথায় রেখেই বলছি, এই
প্রজন্মের সেরা অভিনেতা।
কিন্তু ‘নির্বাক’এর সাফল্য অভিনয়ে নয়।
সাফল্য চিত্রনাট্যে। সাফল্য রাস্তায় বসে সুস্মিতার মোনোলগে রাত ভোর হওয়ায়। সাফল্য
সুস্মিতার সর্বাঙ্গে গাছের চুমুতে। সাফল্য বিঙ্গির পিওভির শটে। সাফল্য মর্গের
ফুলশয্যায়। সাফল্য সিনেমা জুড়ে শারীরিকতার নানান্ স্তরে। সাফল্য প্রতি দৃশ্যে।
সাফল্য আত্মসর্বস্বতার কদর্যে। সাফল্য লোভের নিষ্ফলতায়। সাফল্য মানুষের
সীমাবদ্ধতায়। সাফল্য কলকাতার বিকেলে রাত্রে সকালে ট্র্যাফিকে পার্কে ময়দানে।
সাফল্য এক্সপেরিমেন্টে। আর সাফল্য সাফল্যে।
***
নাঃ, ‘রাজকাহিনী’ ভাল; কিন্তু ‘নির্বাক’ অসাধারণ।
সিনেমাটা আরও বছর দশেক পর বানাল সৃজিত। তাহলে বম্বেতে রিলিজ করা নিয়ে ভাবতে হত না।
darun, osadharon review
ReplyDeleteধন্যবাদ।
DeleteEi prothom, PROTHOM, Nirbak somporke bhalo katha shunlam!
ReplyDeleteকিন্তু ভুল কিছু লিখলাম, বল্?
Deletedarao dekhi aage,tarpor bolchi.Bondhu bandhob ra ja khisti koreche je aar dekhar shahosh kori ni.
DeleteKintu TUMI jokhon eto proshongsha korcho....dekhtei hochche!
দেখ্, দেখ্, ঠকবি না।
DeleteGood Review!!Nirbaak is a good movie! Anjan dutta and ritwick story gulo digest kora difficult holeo reality te hoi! but oi love with tree ir tree r masterbation ota unreal legecche!!
Deleteদেখ্, শর্মিষ্ঠা, দেখ্।
DeleteNirbak amar oshombhob bhalo legechhe. Jani na e deshe er mullayon hobe ki na. Kintu review ekdom sothik. It was pure poetry on reel. Aar Anjan Dutta'r section'ta jara bujhbe na tara Prufrock'o bujhbe na...it takes a special sensitization to present and interpret the apparently ugly. Well done!
ReplyDeleteথ্যাঙ্ক ইউ, ম্যাডাম, থ্যাঙ্ক ইউ।
Delete