BANNER CREDITS: RITUPARNA CHATTERJEE
A woman with the potential to make it big. It is not that she cannot: she simply will not.
PHOTO CREDITS: ANIESHA BRAHMA
The closest anyone has come to being an adopted daughter.

Friday, October 7, 2011

মাঙ্গলিক

আনন্দশীল মঠে সেই বহু প্রতীক্ষিত মুহূর্ত ঘনাইয়া আসিল।

তথাগতের দেহাবসানের কিছু বৎসর পরবর্রতীকালের কথা। মগধে বিম্বিসারের রাজত্বের অবসান ঘটিয়াছে। নিজ রাজত্বকালে বিম্বিসার বৌদ্ধধর্মের নানাবিধ পৃষ্ঠপোষকতা করিয়াছিলেন, তাহার কতকটা পরম সুহৃদের প্রতি প্রণয়জনিত কারণে, কতকটা তথাগতের আদর্শে দীক্ষিত হইয়া। এইরূপে চলিতে থাকিলে হর্যঙ্কবংশের নাম পৃথিবীর ইতিহাসে অদ্যপি স্বর্ণাক্ষরে রচিত থাকিত।

কিন্তু বাধ সাধিলেন অজাতশত্রু। তিনি শুধু সিংহাসনের লোভে পিতাকে কারাবরুদ্ধ করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই: রাজা হইয়া তাঁহার হিন্দু সত্তা রে রে করিয়া ফুটিয়া বাহির হইল। তিনি অবিলম্বে মগধ হইতে বৌদ্ধদিগের সর্বপ্রকার অস্তিত্ব মুছিয়া ফেলিতে ব্যগ্র হইয়া উঠিলেন।

তাই সশস্ত্র রাজপ্রহরী যেদিন ঘোষণা করিল যে মগধের যাবতীয় বৌদ্ধ অধিবাসী অবিলম্বে মগধ ত্যাগ না করিলে তাহাদিগকে হত্যা করা হইবে, সমগ্র প্রবীণ বৌদ্ধ ভিক্ষু মগধ-পার্শ্বস্থ সেই স্বনামধন্য জেতবনে শীর্ষ-সম্মিলনের আয়োজন করিলেন।

***

সঙ্ঘের মুখ্য স্থবির অভয়ভদ্রের ইঙ্গিতে সকলে স্তব্ধ হইল। অভয়ভদ্র প্রবীণ, অশীতিপর, শাক্যমুনির সমসাময়িক বলিয়া বৌদ্ধমহলে বিশেষ কলিকা লাভ করিয়া থাকেন।

তাঁহার শান্ত কণ্ঠস্বর মন্দ্রিত হইল, "মগধে আমাদিগের স্বর্ণযুগের অবসান ঘটিয়াছে। নবীন রাজার বাহুবলের সম্মুখে আমরা অসহায়, মগধ পরিত্যাগ না করিলে আমাদিগের মৃত্যু অনিবার্য। আর অজাতশত্রু অত্যন্ত নির্মম, নিজ পিতাকেই কারারুদ্ধ করিয়া অনাহারে তাঁহার জীবন লইতে দ্বিধাবোধ করে নাই, বিধর্মী বৌদ্ধজাতির রক্তপাতে সে আদৌ পশ্চাৎপদ হইবে না। অতএব এই স্থল হইতে প্রস্থানই শ্রেয়।"

সমবেত সভার বক্ষস্থল বিদীর্ণ করিয়া এক সশব্দ দীর্ঘশ্বাস নির্গত হইল। অভয়ভদ্র যাহা কহিলেন, তাহা সত্য, এবং এ ভিন্ন আর বিশেষ কিছু যে করণীয় নাই, তাহা উপস্থিত সকলেই জানিতেন। তাও, দীর্ঘদিন ধরিয়া যাহা অনিবার্য সত্য বলিয়া তাঁহারা জানিতেন, তাহা সহসা এত শীঘ্র বাস্তব হইয়া দ্বারপ্রান্তে সত্যসত্যই আবির্ভূত হইবে, এতটা তাঁহারা কল্পনা করেন নাই।

সুমেধ বয়সে তরুণ, অতএব এই সমাগমে তাহার স্থান হয় নাই। হিন্দু কাপালিকগণের সমাবেশে হয়ত কৃত্রিম গুম্ফশ্মশ্রুর আশ্রয় লইয়া সে ঢুকিতে পারিত; কিন্তু নবীন বৌদ্ধ ভিক্ষুর পক্ষে প্রবীণের বেশধারণ প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তাহার কৌতূহল অপরিসীম, তাই সে এক পুষ্ট জম্বুবৃক্ষের অন্তরালে লুকাইয়া সকল কথা শুনিতেছিল।

সুমেধ অত্যন্ত বেপরোয়া যুবক। ভিক্ষু হইলে কী হইবে, তাহার আচরণ আদৌ ভিক্ষুসুলভ নহে। জনশ্রুতি আছে, সে লুকাইয়া নানাবিধ মাংস ভক্ষণ করিয়া থাকে, এবং জনৈকা নিষাদ তরুণীর সহিত তাহার সম্পর্ক নিছক বন্ধুত্বসুলভ নহে। কিন্তু তাহার দৃষ্টির মধ্যে এমন এক মায়াবী আকর্ষণ আছে, সঙ্ঘের স্থবিরবৃন্দ সব জানিয়াও তাহাকে ক্ষমার চক্ষে দেখিতেন।

অভয়ভদ্রের সিদ্ধান্ত স্বভাবতঃই তাহার পছন্দ হয় নাই। এই মগধে তাহার জন্ম, তাহার শৈশব। বিম্বিসার যখন বুদ্ধদেবের দর্শনাভিলাষী হইয়া এই জেতবনে আসিতেন, সে কতবার তাহাকে দেখিয়াছে। তাহার দ্বারা ব্যতিব্যস্ত হইয়া সন্ত্রস্ত শশকগণ যখন রাজার আশ্রয় লইত, তিনি সুমেধকে দেখিয়ে কতবার সস্নেহ হাসিয়াছেন। আর আজ এই পিতৃহন্তা নরপশুর ভয়ে তাহাকে পলায়ন করিতে হইবে! অসহ্য!

বৃক্ষের অন্তরাল হইতে সুমেধ বাহির হইয়া আসিল। সে জানিত, স্থবিরবৃন্দ কুপিত হইবেন, কিন্তু পরিস্থিতি মানুষকে নানাবিধ দুঃসাহসিক কার্য করিতে বাধ্য করে।

তাহাকে দেখিয়া অভয়ভদ্র বিস্মিত হইলেও প্রকাশ করিলেন না। বোধকরি বুদ্ধদেবের প্রভাবে আসিবার পর মানুষ দেখিয়া তাঁহার মনে কোনোকিছুই আর বিস্ময়ের উদ্রেক করে না।

"সুমেধ? কী প্রয়োজন?"

"শাস্তা, আমি জানি এখানে উপস্থিত থাকিয়া আমি অনুচিত কার্য করিয়াছি। কিন্তু আপনার সিদ্ধান্তের পর আত্মপ্রকাশ না করিয়া থাকিতে পারিলাম না। আপনি কেন চান, আমরা মগধ পরিত্যাগ করি?"

"সুমেধ, এখানে থাকিলে নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় সাহসিকতার পরিচয় দেওয়া হইবে, কিন্তু এতজন নিরপরাধ ভিক্ষুর প্রাণসংশয় অনিবার্য নহে কি?"

"শাস্তা, আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। উহারা অস্ত্রবলে বলীয়ান্‌ হইতে পারে, কিন্তু আমরা সশস্ত্রভাবে রুখিয়া দাঁড়াইলে উহাদের জয় এত সহজ হইবে না।"

"সুমেধ, তুমি তো অবগত আছ, কোনোরূপ রক্তপাত আমাদের পক্ষে মহাপাপ। তুমি সুগতের বাণী সম্পর্কে অবহিত -"

"শাস্তা, তিনি কি অত্যাচারীর অন্যায় মানিয়া পলায়ন করিবার উপদেশ দিয়াছিলেন?"

"আমরা পলায়ন করিব না।"

সকলে চমকিয়া উঠিল। মহাস্থবির কী চান? কী তাঁহার গূঢ় পরিকল্পনা?

***

না, মগধের বৌদ্ধকুল পলায়ন করে নাই। তাহারা আত্মগোপন করে। নিজ পুত্রের প্রকৃতির পরিচয় পূর্বেই পাইয়া বিম্বিসার জেতবনের নিম্নে এক ভূগর্ভস্থ মঠ নির্মাণ করাইয়া রাখেন। ইহার অস্তিত্ব সম্বন্ধে স্বয়ং বুদ্ধদেব ব্যতীত মুষ্টিমেয় দু-একজন ভিক্ষু অবহিত ছিলেন। অভয়ভদ্র ইহাদেরই অন্যতম।

আনন্দশীল মঠ সম্পর্কে ইতিহাস সম্পূর্ণ নীরব। তাহার কারণ সম্ভবতঃ এই, যে বৌদ্ধরা ইহার গোপনীয়তার ক্ষেত্রে যথাসম্ভব যত্নশীল ছিলেন। শতাধিক প্রকোষ্ঠসমন্বিত এই সঙ্ঘে জীবনধারণের যাবতীয় উপকরণ পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান ছিল। আহার্য, বস্ত্র, শয্যা, বৌদ্ধ পুস্তকরাশি, চিকিৎসার সামগ্রী ইত্যাদি সকল ব্যবস্থা ছিল। সত্য বলিতে কি, কঠোর জীবনধারণে অভ্যস্ত বৌদ্ধগণ এই সহজ জীবনে কিঞ্চিৎ ব্যতিব্যস্তই হইয়া পড়িয়াছিলেন।

সুমেধের মনে শান্তি ছিল না। অজাতশত্রুর জন্য তাহাকে নিজভূমি পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে, ইহা সে কিছুতেই ভুলিতে পারিত না। তদুপরি সঙ্ঘের বিস্বাদ গোধূমচূর্ণ ও লবণান্নের কল্যাণে তাহার জীবন বিস্বাদ হইয়া উঠিয়াছিল। অজাতশত্রুকে কিলাইয়া পনস পাকাইতে পারিলে বোধকরি তাহার কিঞ্চিৎ আরামবোধ হইত, কিন্তু তাহার উপায় নাই। সঙ্ঘের চক্ষু এড়াইয়া অরণ্য হইতে দু-একটা শশক ময়ূর মৃগ শূকর মারিয়া আনিবার উপায় নাই; আর ভিক্ষুণীগুলাও নিতান্তই নীরস, দিবারাত্র ত্রিপিটক আবৃত্তি করিতেই ব্যস্ত, এমনকি অন্ধকার কক্ষে একান্তে সাক্ষাৎ ঘটিলে অস্ফুটে "তমসো মা জ্যোতির্গময়" বলিয়া সলজ্জ পলায়নে অভ্যস্ত। এহেন জীবনে সুমেধ শীঘ্রই হাঁপাইয়া উঠিল।

সুমেধ শুধু দুর্দান্ত দুর্দমনীয় নহে, তাহার কৌতূহলও অপরিসীম। তাহার শ্যেনচক্ষু এড়াইয়া সঙ্ঘে পতঙ্গের পক্ষবিস্তারও সহজ কার্য নহে। হেন কার্য ছিল না, যা তাহার অজ্ঞাত; হেন ভিক্ষু ছিলেন না, যাহার দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে সে অজ্ঞাত ছিল; হেন পুস্তিকা ছিল না, যাহা সে আপাদমস্তক পাঠ করে নাই; হেন কক্ষ ছিল না, যেথায় তাহার অবাধ বিচরণ ছিল না।

কিন্তু এত সত্ত্বেও তাহার কৌতূহল নিবৃত্ত হইত না। এই গুপ্ত সঙ্ঘে বাহিরের খাদ্য বস্ত্র পুস্তকের আবির্ভাব ঘটে কিরূপে? সঙ্ঘের ভিতর আর যাহাই থাকুক, কৃষিজমি নাই, ইহা সুমেধ জানিত। ভূগর্ভস্থ সঙ্ঘে কর্ষণ অসম্ভব।

কিন্তু তাহা হইলে এই বিপুল পরিমাণ গোধূমচূর্ণ ও ধান্যের সমাবেশ ঘটিত কীরূপে?

***

সঙ্ঘের যাবতীয় কক্ষের দ্বার অবারিত ছিল; শুধু একটিমাত্র দ্বার ছিল রুদ্ধ। প্রাজ্ঞ ভিক্ষুগণ ইহাকে মঙ্গলকক্ষ নামে অভিহিত করিতেন। সুমেধ অদ্যবধি উপলব্ধি করিতে পারে নাই, কেন শতাধিক কক্ষের মধ্যে কেবলমাত্র একটিই এই নামে ভূষিত, কেন অবশিষ্ট কক্ষগুলির একটিও "মঙ্গল" নামে পরিচিত হয় নাই।

মঙ্গলকক্ষের অবস্থান ছিল সঙ্ঘের এক প্রান্তে। বজ্রকঠিন লৌহনির্মিত ইন্দ্রকীলকবৃন্দ ছিল ইহার অতন্দ্র প্রহরী। সুমেধ বিভিন্ন ভিক্ষুর অসতর্কতার প্রতীক্ষায় রহিয়াছে, কিন্তু দ্বার ভেদ করিবার কোনোরূপ সুযোগ তাহার হয় নাই। তাহার ব্যর্থ কৌতূহল সমুদ্রতটের উপর তরঙ্গরাজির ন্যায় বারংবার আছড়াইয়া পড়িয়াছে, কিন্তু কক্ষের রহস্য উন্মোচনে কোনোপ্রকারে সক্ষম হয় নাই।

তাহার সমবয়সী তরুণরা কেহই মঙ্গলকক্ষের রহস্য উন্মোচনে ব্যগ্র হয় নাই। তাহাদের ঘটনাবিহীন অনাড়ম্বর জীবন বলিতে ছিল ত্রিপিটক-শ্রবণ, গোধূম ও ধান্য হইতে নানারূপ বিস্বাদ খাদ্য রন্ধন, প্রবীণ ভিক্ষুদিগের সেবা। ইহাদেরই কেহ অবসর সময়ে ভূর্জপত্রে কাব্যচর্চা করিত; কেহ বা কাষ্ঠনির্মিত দণ্ডগুলিকা খেলিতে মত্ত হইত; আর কেহ বা কোনো মৃগনয়নী ভিক্ষুণীর প্রেমে পড়িয়া আহারনিদ্রা ত্যাগ করিয়া পালি ভাষায় সুররসবর্জিত বিরহসঙ্গীত গাহিত।

ইহাদের সহিত সুমেধের বিশেষ সৌহার্দ্য ছিল না। বাল্যকালে স্বয়ং সুগতর সম্মুখীন হইয়াছে সে। তাঁহার অমৃততুল্য দৃষ্টিপাতে সুমেধের প্রজ্ঞালাভ হইয়াছিল। সে বুঝিয়াছিল, তিনি চান না তাঁহার বাণী কেহ অন্ধভাবে অনুকরণ করুক। জগতের সারাৎসার প্রশ্নের সম্মুখীন হইয়া একদিন তিনি নিজে গৃহত্যাগ করিয়াছিলেন - তিনি চাহিতেন সমগ্র মানবসমাজের মস্তিষ্কে সেইরূপ প্রশ্ন ধ্বনিত হউক। তাঁহার অন্ধ অনুকরণ তাঁহার কাম্য ছিল না - তিনি চাহিতেন তাঁহার অনুরাগীবৃন্দ প্রশ্ন করিবার অভ্যাস গঠন করুক।

এই সঙ্ঘের ভিক্ষুরা জ্ঞানী, এবং প্রত্যেকেই অত্যন্ত উচ্চশ্রেণীর মনুষ্য। ত্যাগে, সংযমে, জ্ঞানে ইঁহারা প্রত্যেকে দিক্‌পাল। কিন্তু তাঁহারা অন্ধ অনুকরণে এত মগ্ন যে প্রশ্ন করিবার সহজাত প্রবৃত্তি বিস্মৃত হইয়াছেন।

সেই রাত্রে, প্রদীপের ক্ষীণ আলোকে, উপাধানবিহীন কঠিন শয্যায় শুইয়া সুমেধ ভাবিতে লাগিল। দন্তস্ফোটক কাষ্ঠশলাকার সাহায্যে দন্তমধ্যস্থ ক্ষুদ্র পরিসর হইতে অর্ধপক্ব খাদ্য নিষ্কাশন করিতে করিতে সে নানাপ্রকার চিন্তাভাবনা করিতে লাগিল। ক্রমে ক্রমে তাহার অধরোষ্ঠ প্রসারিত হইল, তাহার মুখে সুস্পষ্ট হাসি ফুটিয়া উঠিল।

অস্ফুটস্বরে সে কহিয়া উঠিল, "এত সহজ? আর আমি এতকাল বুঝি নাই?"

সুমেধ বুঝিয়াছিল, সঙ্ঘের গোপন রসদের যাবতীয় রহস্য ঐ মঙ্গলকক্ষের ইন্দ্রকীলকের অন্তরালেই লুকাইয়া আছে। সেই রাত্রে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইল, যত শীঘ্র সম্ভব এই কক্ষের রহস্য তাহাকে উদ্‌ঘাটন করিতেই হইবে।

প্রহরী না থাকিলে দ্বার উন্মোচন করা দুরূহ হইলেও অসম্ভব নহে। সে বলশালী নহে, কিন্তু সে ঋজু লৌহদণ্ডের চাড় দিয়া ঐ দৈত্যাকার কীলক উন্মোচনের কৌশল আয়ত্ত করিয়াছিল (দুই শতাব্দী পরে আর্কিমিডিস নামক গ্রীসদেশীয় বৈজ্ঞানিক এই আবিষ্কারের কৃতিত্বলাভ করেন, কারণ প্রাচীন গ্রীক সংবাদমাধ্যম প্রচারবিজ্ঞানে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করিয়াছিল)।

কিন্তু প্রহরীদিগকে সরাইবে কীরূপে? নীরস যন্ত্রতুল্য জরদ্গবের দল, শুষ্ক চিপিটকভক্ষণ ও অনর্গল ত্রিপিটক জপে তাহাদিগের দিবস অতিবাহিত হয়, তাহাদিগকে অন্যমনস্ক করিবে কীরূপে? সুখাদ্য নারী সুরা অক্ষক্রীড়াদিতে তাহাদিগের মন নাই - তাহাদের ইস্পাতকঠোর মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটাইবে কিরূপে? সেই রাত্রে সুমেধের নিদ্রা হইল না।

***

পরবর্তী প্রভাতে লৌহদণ্ড লইয়া সুমেধ যখন মঙ্গলকক্ষের সম্মুখে আবির্ভূত হয়, প্রহরীরা তাহার পানে ভ্রূক্ষেপমাত্র করে নাই। তাহারা ধার্মিক আলোচনায় মত্ত ছিল। তাহারা নিরস্ত্র হইলেও রীতিমত শক্তিশালী, তদুপরি সংখ্যায় চারিজন।

বাল্যকালে শশক ধরিতে গিয়া একবার জেতবনে স্বয়ং তথাগতের নিকট সুমেধ ধরা পড়িয়াছিল। মুহূর্তমধ্যে এক নিরীহ নিষ্পাপ হাস্যসঞ্চারে সফল হইয়া স্বয়ং বুদ্ধের মন জয় করিতে সক্ষম হইয়াছিল। এই অপ্রত্যাশিত সাফল্যের পর সে সরোবরের তীরে নিজ প্রতিচ্ছবি দেখিয়া পল-দণ্ড-প্রহর অতিবাহিত করিয়া অনেক অভ্যাসের ফলে সেই ভুবনবিজয়ী হাস্য আয়ত্ত করিয়াছিল।

সেই স্বর্গীয় হাস্য পুনরায় তাহার অধরে ফুটিয়া উঠিল। তাহা দেখিয়া প্রহরীবৃন্দ নিশ্চিন্ত হইল যে ইহার মনে কোনোরূপ অভিসন্ধি নাই।

"তোমরা ইন্দ্রজাল দেখিবে?"

শ্মশানের নিস্তব্ধতা।

"আমি যখন বালক ছিলাম, জেতবনে যাইতাম। স্বয়ং সুগত শিখাইয়াছিলেন। তিনি বলিতেন, যে এই ইন্দ্রজালের মন্ত্র রপ্ত করিতে পারিবে, সে মরণোত্তর নির্বাণলাভ করিবে।"

চারিটি প্রস্তরবৎ গম্ভীর নিশ্চল মুখে চকিত কৌতূহলের আভা দেখা দিয়াই নিভিয়া গেল। মুহূর্তেকের জন্য সুমেধ ভাবিল সে ভুল দেখিয়াছে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও মনে চাপা
উত্তেজনা লইয়াও সেই দেবতুল্য নিষ্পাপ মুখে সুমেধ পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, "দেখিবে?"

নীরব মস্তকহেলনে তাহারা সম্মতি জানাইল।

তাহার হৃৎপিণ্ড দুরুদুরু করিতে লাগিল। প্রস্তরের উপর দণ্ড স্থাপন করিয়া সে উপরদিকে চাড় দিল, এবং সকলে সবিস্ময়ে দেখিল, সেই শীর্ণ লঘু লৌহযষ্টির সাহায্যে কীরূপ অনায়াসে সেই ভীমকীলক খুলিয়া গেল। তাহারা এতই চমকিত হইল যে স্থাণুবৎ দণ্ডায়মান রহিল - বাধা দিবার কথা তাহাদিগের স্তম্ভিত মস্তিষ্কে আসিল না।

কীলক উন্মোচন করিয়া সুমেধ কালবিলম্ব করিল না। হস্তদ্বয়ের যথাসাধ্য চাপে সেই সুবিশাল দ্বার ঘর্ঘর শব্দে খুলিয়া গেল; আর হতচকিত প্রহরী-চতুষ্টয়ের বিমূঢ়তার সুযোগ লইয়া সে সবেগে মঙ্গলকক্ষে প্রবেশ করিল।

প্রহরীদিগের মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ পড়িল। মহাভিক্ষু তাহাদিগকে মঙ্গলকক্ষের দ্বারে প্রহরা দিয়ে বলিয়াছিলেন, কিন্তু কেহ অনুপ্রবেশ করিলে তাহার অনুসরণ করিতে বলেন নাই। তাহারা আদেশের দাস - নিজস্ব বুদ্ধিপ্রয়োগ তাহাদিগের স্বভাববিরুদ্ধ। তাহারা নির্বিকারচিত্তে একমুষ্টি শুষ্ক চিপিটক ভক্ষণ করিয়া পুনরায় দ্বারের প্রহরায় রত হইল।

***

মঙ্গলকক্ষে প্রবেশ করিয়া সুমেধ থতমত খাইয়া গেল। সে সম্ভবতঃ আশা করিয়াছিল গোধূম ও ধান্যে পরিপূর্ণ এক ক্ষুদ্র অন্ধকার প্রকোষ্ঠ দেখিবে। তাহার পরিবর্তে সহস্র প্রদীপের আলোকে আলোকিত এক সুবিশাল কক্ষ দেখিয়া তাহার চক্ষু ধাঁধাইয়া গেল।

ইহাতেই যদি বিস্ময়ের অবসান ঘটিত, তাহা হইলে সম্ভবতঃ সুমেধ অবিচল থাকিত। কিন্তু সে ক্রমশঃ দেখিতে পাইল, কক্ষে সে একাকী নহে - আরও একাধিক মনুষ্য সেথায় উপস্থিত। ইহাদিগের অবয়ব তাহার  ন্যায় হইলেও ইহাদিগের গাত্র লোহিতবর্ণ, তদুপরি ইহাদিগের বস্ত্রও উজ্জ্বল ঘন রক্তবর্ণ। তাহাদিগের অক্ষপটল, দন্ত, নখর সকলই অল্পবিস্তর লোহিত - যেন তাহাদিগের অন্তর্নিহিত পুঞ্জিত রক্ত শরীরের বিভিন্ন অলিন্দপথ দিয়া ফাটিয়া বাহির হইবার উপক্রম করিতেছে।

ইহাদিগের একজন উঠিয়া আসিল। সুমেধের সম্মুখে দাঁড়াইয়া মন্দ্রকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, সহজ পালি ভাষায় - "আমরা জানিতাম তুমি আসিবে, সুমেধ। কয়েক সপ্তাহ ধরিয়া তোমার ক্রিয়াকলাপ আমরা পর্যবেক্ষণ করিতেছি। এই সঙ্ঘে কৌতূহলী ব্যক্তির বড় অভাব, অথচ আমাদের একজন মনুষ্যের বড় প্রয়োজন ছিল।"

"আপনারা...?"

"বিস্মিত হইও না। রাত্রিকালে কখনও সঙ্ঘের প্রাচীর অথবা অরণ্য হইতে নক্ষত্র দেখিয়াছ?"

"হাঁ। এই পৃথিবীকে দিবসকালে সূর্য ও রাত্রিতে চন্দ্র ও নক্ষত্র প্রদক্ষিণ করে। রাত্রির আকাশ মেঘাচ্ছন্ন না হইলে এই নক্ষত্র স্পষ্ট দেখিতে পাই। আকাশের আকৃতি নিম্নমুখী পাত্রের ন্যায়, তাহার সমগ্র অঙ্গে সূর্য চন্দ্র নক্ষত্র অহর্নিশি খেলিয়া বেড়ায়।"

"না, সুমেধ। তোমাদিগের বিজ্ঞান অত্যন্ত প্রাগৈতিহাসিক। তোমরা এখনও এই ধারণার বশবর্তী যে এই বিপুল ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু তোমাদিগের এই নগণ্য গ্রহ, পৃথিবী। এই ব্রহ্মাণ্ডের অজস্র নক্ষত্রের একটি আমাদের সূর্য, তাহাকে ঘিরিয়া নয়টি গ্রহ প্রদক্ষিণ করে; ইহাদিগের মধ্যে তোমাদিগের পৃথিবী তৃতীয়; আর চতুর্থ গ্রহের নাম মঙ্গল। মঙ্গল রক্তবর্ণ গ্রহ - তাহার পর্বত গহ্বর ইত্যাদি সকলই রক্তিম। সেখানে জল নাই, বাতাস বিরল; তাই আমাদিগের জীবনধারণের জন্য এই দুইয়ের প্রয়োজনীয়তা নাই।"

"আপনারা সেই মঙ্গলগ্রহ হইতে আসিয়াছেন?"

"হাঁ। আমাদিগের সভ্যতা তোমাদিগের তুলনায় অনেক প্রাচীন ও উন্নত। যাহা কহিলাম তাহা ব্যতীত, তোমাদের যাহা মূল আহার্য, আমরা সেইসকল খাদ্যসামগ্রী কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় নির্মাণ করিতে সক্ষম হই।"

"আমাদের সঙ্ঘের এই পর্যাপ্ত ধান্য, গোধূম কি তবে...?"

"হাঁ সুমেধ। ইহা আমাদিগেরই অবদান। স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ অজাতশত্রুর এই নিষ্ঠুরতা অনুমান করিয়া বিম্বিসারকে জানান, এবং বিম্বিসার জেতবনের ভূতলে এই সঙ্ঘ নির্মাণ করেন। কিন্তু আহার্য ও অন্যান্য রসদের সমস্যা যে ঘটিবে, তাহা দুজনেরই আশঙ্কা ছিল। এই পরিস্থিতিতে পৃথিবীতে আমাদিগের আবির্ভাব ঘটে।"

"আবির্ভাব?"

"মঙ্গল পৃথিবী অপেক্ষা ক্ষুদ্র গ্রহ, এবং সেথায় প্রাণীর সংখ্যা ও আনুসঙ্গিক বৈচিত্র্য অত্যন্ত অল্প। আমাদিগের বৈজ্ঞানিকগণ ইতিমধ্যেই মঙ্গলগ্রহের যাবতীয় রহস্যের সমাধান করিতে সক্ষম হইয়াছেন। তাই তাঁহারা এক মহাকাশযান নির্মাণ করেন, এবং আমরা অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রের উদ্দেশ্যে বাহির হইয়া পড়ি। আমাদিগের প্রথম গন্তব্যস্থল ছিল তোমাদিগের এই পৃথিবী।"

সুমেধ শ্বাসরুদ্ধ করিয়া শুনিতেছিল। মঙ্গলগ্রহের অধিবাসী থামিতেই সে অধৈর্য হইয়া বলিয়া উঠিল, "তারপর?"

"এখানে অবতরণের পর শুনিলাম গৌতম বুদ্ধের নাম। শুনিলাম, তাঁহার ন্যায় মনুষ্য অদ্যবধি জন্মগ্রহণ করেন নাই। তাঁহাকে দেখিতে আসিলাম, তোমাদিগের এই মগধের সন্নিকটে। হতাশ হইলাম। আমরা আশা করিয়াছিলাম কোনো প্রবল পরাক্রমশালী রাজাধিরাজের দর্শন হইবে। তাহার পরিবর্তে যাঁহাকে দেখিলাম তিনি এক শীর্ণকায় উপবাসক্লিষ্ট কপর্দকশূন্য অক্ষম সন্ন্যাসীমাত্র।"

সুমেধ প্রতিবাদ করিতে গিয়াও করিল না। এইমুহূর্তে সর্বস্ব জানা তাহার পক্ষে একান্ত আবশ্যক।

"বিম্বিসারের দর্শনে যাইলাম। তিনি মহাপরাক্রান্ত রাজা, কিন্তু পুত্রভয়ে ভীত, তদুপরি বুদ্ধের অহিংসার নখদন্তহীন ব্রতে ব্রতী। যাহা হউক, আমাদের প্রয়োজন ছিল এই গ্রহ আর তাহার অধিবাসী সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ। বিম্বিসারকে আত্মপরিচয় দিলাম, আমাদিগের সভ্যতা কতদূর অগ্রসর তাহার পরিচয় দিলাম। তারপর তাঁর অনুরোধে এই ভূগর্ভস্থ সঙ্ঘ নির্মাণ করিলাম, এবং এই সঙ্ঘে অফুরন্ত রসদ কৃত্রিম পদ্ধতিতে নির্মাণের যন্ত্র প্রস্তুত করিলাম। তবে - অবশ্যই বিনামূল্যে নহে।"

মঙ্গল-অধিবাসী থামিল, এবং সুমেধের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া স্মিত হাসিল।

"আমরা পৃথিবীবাসী এক মনুষ্য চাহিয়াছিলাম। বিম্বিসার দিতে আপত্তি জানাইলে আমরা এই সঙ্ঘ ধ্বংসের ভয় দেখাইলাম। তখন তিনি এক শর্তে সম্মত হইয়াছিলেন: এই সঙ্ঘে এক প্রকোষ্ঠ থাকিবে, যেথায় আমরা মাঙ্গলিকগণ বসবাস করিব। যে মনুষ্য সর্বপ্রথম এই কক্ষে প্রবেশ করিবে তাহাকে আমরা লইব।"

"আমি...?"

"হাঁ, সুমেধ। বৌদ্ধ মঠের অধিবাসীদের যান্ত্রিক জীবনদর্শন দেখিয়া আমরা ক্রমশঃ হতাশ হইয়া পড়িতেছিলাম। পরিস্থিতি এমন হয় যে আমরা আর কতক দিবস প্রতীক্ষা করিয়া চীন, পারস্য অথবা গ্রীস নামক যবনদেশের উদ্দেশ্যে যাইতাম। কিন্তু অতঃপর তোমার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করিয়া আমাদের আশা জাগিল, এবং আমরা ভাবিলাম কৌশলে তোমাকে বন্দী করিব। কিন্তু তাহার প্রয়োজন হইল না - তুমি নিজেই আসিয়া ধরা দিলে।"

"একজন মনুষ্য আপনাদিগের প্রয়োজন ছিল যখন - আপনারা কেন বলপূর্বক তাহাকে অপহরণ করেন নাই? কেন এই বিচিত্র শর্তপালন করিতে বাধ্য হইলেন?"

"তুমি বুদ্ধিমান্‌, সুমেধ। আমাদিগের অস্ত্র তোমাদিগের সর্বাপেক্ষা অস্ত্র হইতেও শক্তিশালী। বারুদ নামক বিস্ফোরক পদার্থ দ্বারা তাহা নির্মাণ হয়। তাহার প্রয়োগে মনুষ্যের মৃত্যু ধনুর্বাণ অথবা তরবারি অপেক্ষা সুনিশ্চিত, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তাহার ব্যবহারে গগনভেদী শব্দের উদ্রেক হয়। আমরা নিঃশব্দে কার্যসিদ্ধি করিতে চাই।"

মঙ্গলাধিবাসী ধাতুনির্মিত একখানি নাতিক্ষুদ্র যন্ত্র সুমেধের প্রতি বাড়াইয়া দিল। ইহাতে মরিচা ধরে নাই, অতএব সম্ভবতঃ লৌহ নহে; সুমেধ নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিল। ইহার একপ্রান্তে একটি দীর্ঘ নালিকা। একটি গুরুভার ধাতুখণ্ডে এই নালিকা সংযুক্ত। সেই ধাতুখণ্ড সুমেধ নিজমুষ্টিতে ধারণ করিল, এবং নালিকার উদ্ভবস্থলে অবস্থিত এক স্থূল শলাকাসদৃশ খণ্ডে নিজ তর্জনী স্থাপন করিল। ইহার ব্যবহাররীতি তাহার আদৌ জ্ঞাত না হইলেও কোনো এক অজানা প্রক্রিয়ায় আপন মুষ্টিতে ধৃত সেই ধাতব অস্ত্র তাহার মধ্যে এক অদম্য শক্তি, মানসিক ক্ষমতার সঞ্চার করিল। তাহার মনে হইল, এই অস্ত্রের সাহায্যে সে ভারত জয় করিতে পারে, মগধ কাশী কোশল লিচ্ছবি সকল রাজ্য তাহার বশীভূত হইতে পারে।

"এই যন্ত্রের সাহায্যে আমরা বহুদূর হইতে অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ করিতে পারি। ইহাতে বাণ নয়, সীসার ক্ষুদ্র গুলিকা ব্যবহার হয়, এবং বারুদের সাহায্যে তাহা এত তীব্ররূপে বিদীর্ণ করিবার ক্ষমতা থাকে যে অনেক ক্ষেত্রেই তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটে। তোমাদিগের কোনো অস্ত্র এত শক্তিশালী নহে, কিন্তু ইহার শব্দ এত সাংঘাতিক তীব্র যে অজাতশত্রুর বিশাল সৈন্যদল সেই শব্দে আকৃষ্ট হইয়া আমাদিগকে আক্রমণ করিতে পারে। যুদ্ধ আমাদিগের কাম্য নহে।"

সুমেধ ধাতস্থ হইল। সে জিজ্ঞাসা করিল, "কিন্তু আপনারা কেন এক মনুষ্যের প্রতীক্ষায় এতকাল অতিবাহিত করিয়াছেন?"

"আমরা শশক মৃগ শূকর কুক্কুট হংস মৎস্য মার্জার মূষিক ইত্যাদি প্রাণীর শব ব্যবচ্ছেদ করিয়া তাহাদিগের শরীর মস্তিষ্ক ইত্যাদি বিশ্লেষণ করিয়াছি। এই প্রাণীরা সহজলভ্য, এবং ইহাদের হত্যা নিয়মবিরুদ্ধ নহে। কিন্তু ইহারা বুদ্ধিহীন মূর্খ, আমাদিগের প্রতিদ্বন্দ্বী হইবার ক্ষমতা ইহাদের নাই। আমাদিগের তাই মনুষ্যদেহ ব্যবচ্ছেদ করিবার প্রয়োজন। আমাদের বিদগ্ধ বৈজ্ঞানিকমণ্ডলী এখানে বিদ্যমান, তাহারা তোমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশ্লেষণ করিয়া দেখিবেন মনুষ্যজাতি কোন্‌ কোন্‌ রোগ-ব্যাধিতে নির্মূল হইবার সম্ভাবনা সর্বাধিক, কীরূপে মনুষ্যদেহে বীজাণুর প্রবেশ ঘটে, এইজাতীয় জ্ঞান আমাদিগের জন্য একান্তই আবশ্যক।"

এই প্রথম সুমেধ ভয় পাইল। সে জিজ্ঞাসা করিল, "বীজাণু কী? কেন আপনারা আমাদিগের শরীর, রোগ ইত্যাদি সম্বন্ধে জ্ঞান সঞ্চয় করিতে চান?"

আবার সেই স্মিত, মধুর হাস্য। মঙ্গলবাসী কহিল, "কারণ আমাদিগের গ্রহ অত্যন্ত রুক্ষ, বসবাসের যোগ্য হইলেও ঊষর, কুৎসিত। তোমরা নির্বোধ হইলেও তোমাদিগের গ্রহ অতিশয় সুন্দর - তিন-চতুর্থাংশ ব্যাপিয়া সুপেয় সুনীল জলরাশি, কর্ষণ ও খননের উপযোগী সুন্দর ধরিত্রী। এই গ্রহে আসিয়া অবধি আমাদিগের প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা চলিয়া গিয়াছে। তোমাদিগের পরিবর্তে এই গ্রহে আমরা রাজত্ব করিব। উপরন্তু আমাদিগের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তোমাদিগের অপেক্ষা বহুগুণে বেশি এবং তোমাদিগের গ্রহ মঙ্গল অপেক্ষা বৃহৎ।"

"কিন্তু তাহার জন্য মনুষ্যজাতীকে নিশ্চিহ্ন করিবার প্রয়োজন কি? আপনারাও পৃথিবীতে বাস করিতেই পারেন, আমাদিগের সহিত। এই বিপুলা পৃথিবীর অনেকাংশে অদ্যপি মনুষ্যপদচিহ্ন পড়ে নাই। আপনারা সেইসকল স্থানে বসবাস করিবার প্রচেষ্টা করিতেছেন না কেন?"

"কারণ আমরা বিবাদ পছন্দ করি না। আমরা চাহি নিরঙ্কুশ রাজত্ব - সেই গ্রহে মাঙ্গলিক ভিন্ন বুদ্ধিমান্‌ প্রাণীর কোনোরূপ অস্তিত্ব থাকিবে না। আর, নিশ্চিহ্ন করিবার কথা তো কহি নাই। আমাদিগের পদ্ধতি অনেক সূক্ষ্ম, প্রাণীহত্যা ব্যতিরেকেও আমরা অনায়াসে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব করিতে সক্ষম হইব।"

***

মঙ্গল-অধিবাসীর নির্দেশে তাহারই কিছু অনুচর তাহার হস্তদ্বয় বন্ধন করিয়া এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করিল। জীবনে সম্ভবতঃ প্রথমবার সুমেধ যৎপরোনাস্তি অসহায় বোধ করিল। শুধু তাহার তুচ্ছ জীবন নহে, আসমুদ্রহিমাচল এই ভারতবর্ষ শুধু নহে, এই সর্বংসহা বসুন্ধরা এবং এই যুধ্যমান মানবজাতি সম্যক্‌রূপে নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইবে।

তথাগত অহিংসার বাণীতে মনুষ্যজাতিকে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলেন। কিন্তু অহিংসার দ্বারা এই মাঙ্গলিকদের হিংস্র সর্বগ্রাসী নিষ্ঠুরতা হইতে মানবসমাজের মুক্তি সম্ভব? কিন্তু কিছু তো করিতেই হইবে – এইপ্রকারে অসহায়ের মত পরাভব স্বীকার সে কোনোপ্রকারেই করিবে না।

ভাবিতে ভাবিতে সুমেধ ক্রমশঃ তন্দ্রাচ্ছন্ন হইল, তারপর একসময় গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হইল। অপরিসীম ক্লান্তি-অবসাদের মধ্যে তিলমাত্রের জন্যও তাহার সন্দেহ হইল না, তাহার প্রকোষ্ঠে যে সুমিষ্ট গন্ধযুক্ত বর্ণহীন ধূমরাশি প্রবেশ করিতেছে, তাহাই তাহার আকস্মিক প্রগাঢ় নিদ্রার মূল কারণ।

***

দিবসকাল অতিবাহিত হইল। দুইজন ভিক্ষু সঙ্ঘের প্রাকারের সম্মুখে সুমেধের অচৈতন্য দেহের সন্ধান পাইল। সঙ্ঘের ভিক্ষুদিগের শুশ্রূষায় সুমেধ সারিয়া উঠিল বটে, কিন্তু ক্রমেই জানা গেল, এই ব্যাধি সংক্রামক। দিবসব্যাপী জ্বর, অচৈতন্য ভাব, দুর্বলতা, কিন্তু তাহার পর পুনরায় সুস্থতালাভ।

সঙ্ঘের প্রত্যেক ভিক্ষু ক্রমশঃ এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হইল, এবং অচিরেই সুস্থও হইয়া উঠিল। যদি পরীক্ষার কোনোরূপ উপায় থাকিত, চিকিৎসকেরা জানিতে পারিতেন যে এই আপাতনিরীহ ব্যাধির ফলে আনন্দশীল মঠের অধিবাসীদিগের রক্তে লৌহকণিকার পরিমাণ বহুগুণ বাড়িয়া গিয়াছে, এবং এই লৌহকণিকার উপাদান পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকদের অজানা, সম্ভবতঃ জল এবং বাতাস বিরল এমন কোনো পরিমণ্ডলে সৃষ্ট।

তারপর একদিন, অকস্মাৎ, আনন্দশীল মঠের সমস্ত ভিক্ষু একসঙ্গে প্রাণত্যাগ করিল। রক্তের ক্রমহ্রসমান শ্বেতকণিকা তাহাদিগের পার্থিব দেহ সহ্য করিতে পারিল না।

***

পরদিন আনন্দশীল মঠের ভিক্ষুদিগের প্রতিনিধিবৃন্দ অজাতশত্রুর সহিত দেখা করিলেন। তাঁহারা শপথ করিলেন, আনন্দশীল মঠ এবং মগধ ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইবেন।

তৃপ্ত অজাতশত্রু পরদিনই কঠিন জ্বরে আক্রান্ত হইলেন, কিন্তু অচিরেই অব্যাহতি লাভ করিলেন। তাঁহার রানীরা, সভাসদ্‌বৃন্দ, এবং ক্রমশঃ অবশিষ্ট মগধ এই ব্যাধিতে জর্জরিত হইল। এবং তাহাদিগের নিরাময়ও অতি সত্বর ঘটিল।

***

কতিপয় দিবস পরের ঘটনা। মগধের শ্মশানে এক সুবিশাল দিগন্তবিস্তৃত চিতারাশির অন্তরাল হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া কয়েকশত রথারূঢ় মগধবাসী ভারতবর্ষের নানাস্থানে রাষ্ট্রদূতরূপে ধাবিত হইলেন। কেহ বা জলপথে বলিদ্বীপ-সিংহলের উদ্দেশ্যে।

ক্রমশঃ সেই মহামারী সমগ্র পৃথিবীতে ছড়াইয়া পড়িল। সমগ্র মনুষ্যজাতি আক্রান্ত হইল, মরিল, এবং আশ্চর্যজনকরূপে পুনর্জীবিত হইল। এই ঘটনা এতই অবিশ্বাস্য যে ইতিহাসে ইহার সম্বন্ধে কোনোরূপ উচ্চবাচ্য নাই।

***

মঙ্গলের জল ও বাতাস ইতিপূর্বেই বিরল ছিল। এখন হয়ত একেবারেই নিশ্চিহ্ন, কোনোরূপ প্রাণের নিদর্শনও নাই এইমুহূর্তে। বিস্ময়ের কথা, পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং সমগ্র মানবজাতির রক্তে লৌহকণিকার পরিমাণ পূর্বের হইতে বহুগুণে অধিক।

20 comments:

  1. Hmm....bhalo hoyechhe. kintu doubt ese gelo je. amra tahole ki? Parthib, na Mangolik?

    ReplyDelete
  2. লেখকের লেখনীশক্তির প্রশংসা করিয়া খাটো করিব না। এই লেখাটিকে awesome বলিলেও যথার্থ হইবে না। একটি কথাই শুধু বলিতে পারি, আজ আরেক স্বনামধন্য বঙ্গসন্তান, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবিত থাকিলে বলিতেন, "সাধু, সাধু!" এবং অনুমান করিতে পারি, প্রাণভরে এই নবীন লেখককে আশীর্বাদ করিতে কুন্ঠিত বোধ করিতেন না।

    ReplyDelete
  3. অদ্ভুত, অনন্য, অবিশ্বাস্য, অসাধারণ অভিষেক। লিখিতে থাকুন, গুণমুগ্ধরা তৃপ্ত হউক।

    ReplyDelete
  4. Amazing... never read anything like this on a blog.

    ReplyDelete
  5. ঘ্যাম তো!

    ReplyDelete
  6. eai lekhata tomar bhalo lekha gulor modhye ekta..besh bhalo hoyechhe. tobe eber ekta golpo lekho jetate ektao lok /prani mara jabe na.

    ReplyDelete
  7. Saradindu would be proud of this! Good one :)

    ReplyDelete
  8. puratoni chhanche adhunik dhancher golpo!!nijoswota achhe,vabnay ebong lekhar style a..nikhut bornona,khutinati bishoyer dike nojor nissondhehe proshongsar dabi rakhe.porinoto lekha,ebong protiti line a jotner chhap susposto!amar perfect legechhe!!:)

    ReplyDelete
  9. Sharadindu meets H.G. Wells... darun hoyechhe lekhata... thik Sharadindu-r moto kiliye knathal pakiye deoyar funda-ta darun laglo. ebong aboshyi Asterix-r moto additional input-ta. Etao niye jeo.

    ReplyDelete
  10. সুন্দর হইয়াছে । তবে ইহা যদি 'শরদিন্দুর প্রতি শ্রধার্ঘ্য' হইয়া থাকে, সেক্ষেত্রে বলিতে দোষ নাই যে বিশেষ জমিল না, কারণ বিষয়বস্তু শরদিন্দু-ঘেঁষা নহে, আদপেই ।

    'চিপিটক' আর 'ত্রিপিটক' নিঃসন্দেহে দূর্দান্ত মিত্রাক্ষরকারী শব্দ কিন্তু বারংবার ব্যবহারজনিত দোষে দুষ্ট ।

    কাহিনীর বুনট সবিশেষ প্রশংসার দাবী রাখে । শেষ অবধিও অনুমান করা যায় নাই যে কি ঘটিতে চলিয়াছে ।

    সুমেধ-এর চরিত্রটির রূপায়ণ খুবই সুন্দর । শরদিন্দুর গল্পে সাধারণতঃ একজন সর্ববিষয়ে পারদর্শী নায়ক থাকে (খানিকটা এ'যুগের হিন্দী বা বাংলা ছায়াছবির মতো), সুমেধ কতকটা সেইরকমই ।

    তবে গল্পে একজন নায়িকা বা কমপক্ষে একটি বলিষ্ঠ নারীচরিত্রের অভাব বোধ করিলাম । ইহা সচরাচর শরদিন্দুর গল্পে ঘটে না ।

    যাহাই হউক, মোটের উপর বেশ ভাল । ১০ এ ৮ দিলাম ।

    ReplyDelete
  11. For me this is the most enjoyable of your stories. The story has an interesting historical setting, a chilling storyline, complete with interesting and scientific sounding remarks to make things very believable. Not to mention the Sadhu bhasha as though this was a historical document. Stylistically
    well implemented and thought out.

    I did get stuck a few times:
    a) the Martians don't want war, but don't mind killing the humans?
    b) They could not kidnap someone ?
    c) I was confused how the bhikkus managed to go to Ajatashatru after they died. I guess they were brought back to life (as is stated for others later, but I did not get that when talking about the Bhikkus).

    Anyway, this was really great.

    (PS: I personally cannot think in Sadhu bhasha, and have to translate my thoughts from chalit to Sadhu). Perhaps others like you, even from my generation, can think in Sadhu?

    ReplyDelete
  12. Thanks everyone. RGB, as for point c, read again.

    ReplyDelete
  13. Sorry for being a tubelight, but I am probably still missing it.

    তারপর একদিন, অকস্মাৎ, আনন্দশীল মঠের সমস্ত ভিক্ষু একসঙ্গে প্রাণত্যাগ করিল। রক্তের ক্রমহ্রসমান শ্বেতকণিকা তাহাদিগের পার্থিব দেহ সহ্য করিতে পারিল না
    পরদিন আনন্দশীল মঠের ভিক্ষুদিগের প্রতিনিধিবৃন্দ অজাতশত্রুর সহিত দেখা করিলেন।
    are the representatives not Bhikkhus themselves, or did they come back to (other's) life in between.

    ReplyDelete
  14. RGB, মঙ্গলের জল ও বাতাস ইতিপূর্বেই বিরল ছিল। এখন হয়ত একেবারেই নিশ্চিহ্ন, কোনোরূপ প্রাণের নিদর্শনও নাই এইমুহূর্তে। বিস্ময়ের কথা, পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং সমগ্র মানবজাতির রক্তে লৌহকণিকার পরিমাণ পূর্বের হইতে বহুগুণে অধিক।

    If you're still confused, drop me an email at ovshake at gmail dot com.

    ReplyDelete
  15. অহো! কি পাঠ করিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না! বৎস সুনন্দ এই রচনার সন্ধান না দিলে, এই অনিবর্চনীয় লেখনীর স্বাদ হইতে বঞ্চিত হইতাম।
    বিজ্ঞান এবং ইতিহাসের মেল বন্ধনে এই রচনাটি এক অনিন্দ্যসুন্দর অবয়ব লাভ করিয়াছে।
    মুখোটি
    তোমার প্রতি আমার আশীর্বাদ!
    তোমার লেখনী হিরন্ময় হউক!

    ReplyDelete
  16. ami louhokonika kintu kom :D aj e report eseche :P bangla bhasaye dokhol kintu darun :) oshadharon lekha :)

    ReplyDelete
  17. Replies
    1. না। ইহা বড়গল্প, অর্থাৎ ক্ষুদ্রোপন্যাস।

      Delete
  18. শরদিন্দু না “না-শরদিন্দু” জানিনা... কিন্তু ঐ “...অস্ফুটে "তমসো মা জ্যোতির্গময়" বলিয়া সলজ্জ পলায়ন...”, “...দন্তস্ফোটক কাষ্ঠশলাকার সাহায্যে দন্তমধ্যস্থ ক্ষুদ্র পরিসর হইতে অর্ধপক্ব খাদ্য নিষ্কাশন...”, আর “...প্রাচীন গ্রীক সংবাদমাধ্যম...” - আমার কাছে এক-কথায় “ঐতিহাসিক রচনা।সবমিলিয়ে পড়তে দারুন লেগেছে।
    পুনশ্চ ঃ~ একটা আত্মতৃপ্তি - যাক। মঙ্গল-এর বিজ্ঞানীরাও ভুল করে। আমাদের “তিন-চতুর্থাংশ ব্যাপিয়া সুনীল জলরাশি”-টা “সুপেয়” বুঝি? ভাগ্যিস, ওদের “ভূ-গোল” এর বদলে “মং-গোল”...নইলে বিজ্ঞ হওয়া তো দূর, মাধ্যমিক-ও পাশ করতে হতো না।

    ReplyDelete

Followers