BANNER CREDITS: RITUPARNA CHATTERJEE
A woman with the potential to make it big. It is not that she cannot: she simply will not.
PHOTO CREDITS: ANIESHA BRAHMA
The closest anyone has come to being an adopted daughter.

Thursday, February 21, 2019

একুশে


গাড়িটা ঘিরে ধরেছিল বঙ্গরক্ষকের দল। ঋষভ চৌহানকে হিড়হিড় করে টেনে নামাল। আজ একটা হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বে না।

এই গ্যাংটা খুব উঠেছে আজকাল। আগে সাধারণতঃ চুপচাপ থাকত, “অবাঙালি হঠাও” স্লোগান শোনা যেত মাঝেমধ্যে। এখন রীতিমত সশস্ত্র আক্রমণ করে।

এদের টার্গেট মূলতঃ কলকাতার অবাঙালিরা। আর তনিমা পালিতের মত বাঙালি মহিলার অবাঙালি স্বামী হলে তো কথাই নেই। কুড়ি বছর হল তাঁদের বিয়ের, কলকাতায় দিব্যি আছেন তাঁরা। বাংলাটা বুঝলেও তেমন বলতে পারেন না ঋষভ; ঐ ভাঙা ভাঙা বলে কাজ চালিয়ে নেন।

গাড়ির ভেতর আটকে রেখেছিল ওরা তনিমাকে। দেখতে বাধ্য করেছিল। তনিমা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলছিলেন বারবার, কিন্তু ওরা নাছোড়বান্দা।

এদের পরীক্ষার পদ্ধতি খুব সহজ। মানুষকে টেনে নামায়, নামিয়ে দু’তিনটে ইংরিজি বাক্য অনুবাদ করতে দেয়, না পারলে বা ভুল বললে গণপ্রহার। ঋষভ এমনিতেই রোগাপট্‌কা, পনেরো-কুড়িজনের সঙ্গে এঁটে ওঠার কোনওরকম সম্ভাবনা নেই। আর পুলিশও এদের ব্যাপারে নাক গলায় না।

এই একুশে ফেব্রুয়ারির আশেপাশে এদের দৌরাত্ম্য বাড়ে। বুদ্ধি খাটিয়ে এই কটা দিন কলকাতার বাইরে কাটিয়ে আসা উচিত ছিল।

ঋষভের এই অবস্থার জন্য আজ তিনিই দায়ী। বারবার বলেছিল ব্যাঙ্গালোর যেতে, বেশি মাইনের চাকরি পাচ্ছিলেন দু’জনেই, কেন জেদ করে থেকে গেলেন তিনি?

*

কিন্তু আশ্চর্য কাণ্ড, ঋষভকে ছেড়ে দিল এরা। রীতিমত সরি-সরি বলে একশা করে গাড়িতে তুলে দিল।

“কিছু মনে করবেন না স্যার। অবাঙালি তো কী হয়েছে, আপনি যা বাংলা বলেন তা অনেক বাঙালিও বলতে পারেন না। আপনারা থাকলে ভাষার ভাল হবে।”

*

“এটা কী হল?”

“What?”

“তোকে ওরা ছেড়ে দিল কেন?”

“Oh, they gave me a piece of paper and asked me to translate that to Bangla, and I did.”

“তুই? তুই বাংলা করলি? আর সেই বাংলা শুনে ওরা তোকে ছেড়ে দিল? কই দেখি, কী বাংলা করতে দিল।”

কাগজটা বাড়িয়ে দিলেন ঋষভ।

“I love celebrating Bhasha Divas. I am with you in this battle, because it is necessary.”

“তুই কী বললি?”

“আমি ভাষা দিবস মানাতে ভালবাসি। এই যুদ্ধে আমি আপনাদের সাথ দেব, কেন কি এটা দরকার।”

*

(এই জাতীয় একটা গল্প অনেকদিন আগে পড়েছিলাম, ধর্ম না জাতীয়তাবাদ কী একটা নিয়ে। তাই মৌলিক গল্প বলতে একটু সঙ্কোচ হচ্ছে। তবে যদি কারুরই মনে না পড়ে আমি মোটামুটি নিরাপদ।

ও হ্যাঁ, ভাষা দিবসের শুভেচ্ছা নেবেন।)

Saturday, February 16, 2019

সেই বাবরিচুল লোকটার গল্প


মূল গল্প: Blue Notebook No. 2
লেখক: Daniil Kharms
অনুবাদ নয়, “ছায়া অবলম্বনে”

***

সে একটা বাবরিচুল লোক ছিল। লোকটার চোখও ছিল না, কানও ছিল না। বললে বিশ্বাস করবেন না, লোকটার চুলও ছিল না, তাই আমার ধারণা যারা বলত ওর বাবরি চুল তারা সম্পূর্ণ অকারণে বলত। এমনি এমনি, বানিয়ে বানিয়ে

লোকটা কথা বলতে পারত না, কারণ ওর মুখও ছিল না। নাকও না

এমনকি ওর হাত-পাও ছিল না। বুক-পেট-কিডনি কিচ্ছু না। পিঠও ছিল না, তার মানে লোকটা ছিল মেরুদণ্ডহীন।

মানে একেবারে কিছু ছিল না। সামান্যতম কিছুও না।

সমস্যাটা কোথায় এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। কিছুই ছিল না, তাই কার সম্পর্কে কথা বলছি বোঝানো শক্ত।

তাই আমার মনে হয় লোকটার ব্যাপারে আর কিছু না বলাই ভাল।

Friday, February 15, 2019

মূষিক



মূল গল্প: Barney
লেখক: Will Stanton
অনুবাদ নয়, “ছায়া অবলম্বনে”

***
To: Joy.Banerjee@rodentia.co.in

আজ মূষিক অনেকটা সময় একা চুপচাপ বসেছিল। এত বছর রিসার্চ করছি, শান্ত ইঁদুর আমি দেখিনি তা নয়, কিন্তু এ সে জিনিস নয়। দেখেই বোঝা যায় কিছু একটা ভাবছে।

তুই ভাল থাকিস্‌। কবে আসবি জানাস্‌।

*

To: Joy.Banerjee@rodentia.co.in

আজ মাস্কুলাসের ডোজটা আরেকটু বাড়ালাম। কোনও অসুবিধে হল না। তবে বুদ্ধি যে বাড়ছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, কারণ আজ দেখি টেবিলের ওপর উঠে আমার দাড়ি কামানোর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ দেখছে।

কাল আরেকটু ডোজ বাড়াব।

*

To: Joy.Banerjee@rodentia.co.in

মারাত্মক ব্যাপার। একটা কৌটোর মধ্যে বিস্কুট রেখেছিলাম ওর সামনে। ঢাকনাটা খুলে বিস্কুটটা নিল – তা সে তো অনেক ইঁদুরই নেয়, কিন্তু খাওয়ার আগে ঢাকনাটা আবার পরিয়ে দিল।

এখনও তর্ক করবি? দাঁড়া, এরপর আরও ডিটেল দেব।

*

To: Joy.Banerjee@rodentia.co.in

আরে, আর বলিস্‌ না, আগের ইমেলটা লিখে আবার আনন্দমঠ শুরু করব, দেখি বঙ্কিম রচনাবলীর ওপর তিনি বসে। অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখ বাঁদিক থেকে ডানদিকে নিয়ে যাচ্ছে। পড়তে অবভিয়সলি পারছে না, কিন্তু তোর দেখলে মনে হবে পড়ছে। আমার ধারণা আমাকে পড়তে দেখে নকল করছে।

*

To: Joy.Banerjee@rodentia.co.in

দেখলি তো, ওয়েবক্যামে? এটা নতুন শুরু হয়েছে। ল্যাপটপের কীবোর্ডের পাশে বসে থাকছে। জ্বালাতন করছে না, কিন্তু কখনও স্ক্রীন কখনও কীবোর্ড দেখেই চলেছে। সত্যজিৎবাবু আজ জন্মালে “কর্ভাস”এ এটা নির্ঘাত ঢোকাতেন।

*

To: Joy.Banerjee@rodentia.co.in

কাল থেকে একটা কথা মাথায় ঘুরছে, জানিস্‌ তো? দেখ্‌, এক্সপেরিমেন্ট তো সাক্সেসফুল। এবার মূষিককে ছেড়ে দেওয়া উচিত আমার। কিন্তু ওর সংস্পর্শে এসে যদি বাকি ইঁদুরদের বুদ্ধি ওর মত বাড়ে, আমরা সেফ থাকব?

কোথায় একটা পড়েছিলাম কলকাতা শহরের নিচটা পুরো ঝাঁজরা, ইঁদুরের গর্তের টানেলে ভর্তি, যেকোনও দিন ধসে পড়বে। তারপর যদি বুদ্ধি আরও বাড়ে, টেকনোলজি শিখতে শুরু করে, এঁটে উঠতে পারব?

না না, এক্সপেরিমেন্ট আপাততঃ এক্সপেরিমেন্টের জায়গাতেই থাক্‌। কাল থেকে ঐ পার্টিশনের ওদিকে রেখেই যা করার করব। হয়ে গেলে চাবি দিয়ে রাখতে হবে। তেমন হলে হালকা সেডেটিভ।

*

To: Joy.Banerjee@rodentia.co.in

মনে হয় না মূষিক ব্যাপারটা ভালভাবে নিয়েছে। সমানে কিচমিচ করে চলেছে।

*

To: Joy.Banerjee@rodentia.co.in

একটু আগে সাংঘাতিক কাণ্ড হয়েছে। পার্টিশনের দরজাটা খুলে ঢুকে সবে আলোটা জ্বেলেছি, এমন সময় তীরবেগে বেরিয়ে গেল। ল্যাচের চাবিটা লাগানো ছিল, নিয়ে সোজা কুয়োর জলে। দরজা বন্ধ করার আর কোনও উপায় নেই।

তবে তারপর থেকে এক্কেবারে শান্ত, চুপচাপ। ওর বুদ্ধিতে খুশি হব না শয়তানিতে রাগব না টেনশন করব বুঝে উঠতে পারছি না।

চাবি নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। কুয়োটা অনেক বছরের। এই গরমে কয়েক ইঞ্চি জল থাকে, তাও হয়ত নয়। কাল দড়ি বেঁধে নেমে আমি তুলে নেব। রিস্ক নিয়ে লাভ নেই, ওকে আটকেই রাখতে হবে।

*

To: Joy.Banerjee@rodentia.co.in

মূষিককে নিয়ে বেকার টেনশন করছিলাম। আজ কুয়োয় নেমেছি। যতক্ষণ নামছিলাম ওপর থেকে কিচমিচ শব্দ। বেচারার একা থাকতে বোধহয় অসুবিধে হয়। সেইজন্যই পার্টিশনের ওদিকে থাকতে চাইছিল না।

জলের ঠিক ওপর অবধি পৌঁছেছি, এমন সময় টর্চটা নিভে গেল। ওপরে উঠতে বাধ্য হলাম। উঠে দেখি পাথরের গায়ে ঘষা লেগে দড়িটা বেশ অনেকটা ক্ষয়ে গেছে। আর ঐ সারাক্ষণ কিচমিচ চলছে।

সাবধান করতে চাইছিল নাকি? এত বুদ্ধি ইঁদুরের হয়? হতেও পারে, কুকুর তো এইর’ম করে থাকে শুনেছি। দেখি, কাল আবার নামব। নতুন দড়ি লাগবে, আর টর্চে নতুন ব্যাটারি।

*

To: Joy.Banerjee@rodentia.co.in

মুসিকের ম্রিত্যু হয়িয়াছে। আমি খুব কস্ট পাইতেছি। আমি কুয়ার মদ্দে লাফ দিয়া ম্রিত হইব। তুমি জদি আস অন্যো ইদুর লইয়া আসিবে। মুসিক নাই কিন্তু একানে উয়ারা মুসিকের মত থাকিবে আর খুসি হইবে।

উয়াদের রাকিয়া তার্পর তুমি চলিয়া জাইবে। সব ইদুর মেয়ে হয় জ্যানো।

Thursday, February 14, 2019

February in exile


It was about eight in the evening, Kolkata, or perhaps later. I wanted a breather after a hard-fought train journey back home, so I chose to take a minute out of the routine to lean on the footbridge railing and watch trains pass.

But Mumbai shoved me aside on that footbridge, Kolkata. She did not let me watch trains in the evening in peace, for doing something without a reason clashes with the principles on which she functions. Left without a choice, I had to drag myself home.

And that, Kolkata, tops this list of February rants. I know I have brought this one up before, but this one is unlikely to desert me. Of all cultural shocks I have encountered in this incredible city, this has been the rudest.

Why am I telling you the same story yet again, Kolkata? Why wouldn’t I? There is no one else who will get this. And it has to be in February as well – for that is when I miss you the most.

It used to be different in Navi Mumbai. Serene, relaxed, she almost reminded me of you, Kolkata. She could have been one of us, you know. Instead, she belongs to a family almost entirely dominated by her glamorous elder sibling who has decided to forego leisure for prosperity.

And yet, despite clogging my senses with smog, despite wearing me down with traffic, Mumbai has given me shelter when others had turned their backs on me. This, despite her persistent efforts to convince me that yeast-processed flour lumps sliced open and stuffed with lipid-processed tuber discs qualify as food.

No, I cannot help but be grateful to her. But then, that is gratitude – and gratitude doesn’t make a city home, and both of us know that, Kolkata.

I know I am ranting, but this city, despite her glamour and bustle and skyscrapers and pomfrets, refuses to be home.

Sometimes I wonder, Kolkata, why I care for you so much. You are dying. Your language is dying. You prefer to be stuck in an almost uniquely glorious past. You live in a constant state of denial, refusing to believe that the world has moved on and your present has failed to live up to the standards of your past.

You have ceased to be yourself in your maniacal aspiration for prosperity and glitz long time ago. You have failed spectacularly, not only in fulfilling your dreams but also in doing what you used to do best. Worse, you do not even want to be in the run anymore.

Perhaps you have lost the gumption for that one final battle for supremacy. You choose to writhe in agony instead. Just like this blog, parented by you and this month and fostered and now almost abandoned by me.

And yet you are home, for I don’t share memories with anyone the way I do with you. And our shared memories go back a long way, remember?

You know about that one girl in a yellow saree more than twenty-five years ago. You know how she stood out in a group of friends near Manohar Pukur Road. You remember those five minutes or maybe fifty, for you, unlike me, always had the sense to look beyond those long eyelashes. You know I never saw her again but will know her the day I do.

Memories, Kolkata, memories, so many of them, so many, of school and of college and of romances and of so many firsts. Of February, of polash, of books new and old, of George Biswas on “mono” music systems, of Vividh Bharati, of bat on ball, of Priya and Menoka and Basusree and Bijoli and Bharati and Kalika and Indira and Rupali, of evening walks.

I wonder how you celebrated Book Fair this February. Or your customised Valentine’s Day – when you drape your enticing femininity in yellow saree – a day absurdly superior to its synthetic impersonation the world prefers to celebrate on February 14.

Are you persuading them to draw the sheets at four in the morning this February as well? Is winter still busy warding off summer in her valiant annual battle? Are the prickly heat powders out already? What about the “season-change” warnings from anxious mothers?

Or have things changed completely?

But then, that is not possible… for is February not your month to don the crown? Is it not the time when the world looks at you in envy, in awe, in – you tell me, Kolkata, for I am running out of words and emotions and more.

But then, is that not what is expected when I think of you in February?

Wednesday, February 13, 2019

অংশুমান দাশগুপ্তর অ্যাক্সিডেন্ট



মূল গল্প: Co-Incidence
লেখক: Edward D Hoch
অনুবাদ নয়, “ছায়া অবলম্বনে”

***

দোষটা অংশুমান দাশগুপ্তরই ছিল। সিসিটিভিতে দেখা গেছে তিনি দৌড়ে রাস্তা পেরোচ্ছিলেন, তাও সিগন্যাল খোলা না থাকা সত্ত্বেও। ভেজা রাস্তায় সময়মত ব্রেক করে উঠতে পারেনি ড্রাইভার।

সাধারণতঃ ছুটে রাস্তা পার হতে হত না তাঁকে, কিন্তু সেদিন বেরোতে কয়েক মিনিট দেরি হয়ে গেছিল। ঠিক তিন মিনিট সাতান্ন সেকেন্ড দেরি, আমি ঘড়ি দেখছিলাম। কেন দেখছিলাম সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

অংশুমানবাবু সাধারণতঃ ঠিক পাঁচটা সাতাশে ডেস্ক থেকে উঠে পাঁচটা একত্রিশে অফিস থেকে বেরিয়ে যেতেন। পাঁচটা চুয়াল্লিশের লোকাল ধরতেন তারপর। এতবড় পোস্টে থাকা সত্ত্বেও তিনি ট্রেনে যাতায়াত করেন – করতেন – কারণ তাতে যাতায়াত মিলিয়ে প্রায় তিনঘণ্টা বাঁচত।

ঐদিন অংশুমানবাবুকে পাঁচটা ছাব্বিশে ধরে ফেলেছিল সুজাতা, নাগপুরের আউটলেটের স্টকের ব্যাপারে কথা বলতে। কথা সামান্যই, কিন্তু মিনিটচারেক দেরি হয়ে যায় অংশুমানবাবুর। তাতেও তিনি পাঁচটা চুয়াল্লিশের আশা ছাড়েননি।

একদিন ট্রেন মিস্‌ করলে কী ক্ষতি হত কে জানে।

*

তিরিশ বছর আগে কলেজ স্ট্রীটের বইয়ের দোকানটার একটা ব্রাঞ্চ খুলেছিলেন শমীক সোম, হাজরা রোডে। তারপর হাওড়ায়। আজ দেশে একশো তিপ্পান্নটা আউটলেট। ক্রসওয়র্ড স্টারমার্কের মুখে ছাই দিয়ে এখন শম্বুক দেশের এক নম্বর বুকস্টোর।

সুজাতা শম্বুক জয়েন করেছিল পাঁচ বছর আগে। সদ্য ইউনিভার্সিটি পাশ ডেটা অ্যানালিস্ট। ওর হাত ধরে শম্বুকের সেলস তরতর করে বাড়তে থাকে।

সুজাতার কাজের পদ্ধতি আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আমি ওর তিন মাস আগে শম্বুকে এসেছিলাম, তার আগে বুকমার্কে কাজ করতাম। আমি জীবনে কখনও কাউকে এইভাবে কাজ করতে দেখিনি।

পাঁচ বছরে সুজাতা একবারও শম্বুকের কোনও স্টোরে যায়নি। যাওয়ার দরকার নেই নাকি। সেই সময়টা অফিসে বসে সারাক্ষণ কম্পিউটরে নানান্‌ সফটওয়্যার খুলে কোড লিখত। কোথায় পুনের কোন্‌ আউটলেটে একশো কুড়ি কপি হ্যারি পটার মঙ্গলবার সকালের মধ্যে পাঠাতে হবে, কবে ভুবনেশ্বর থেকে তিরিশ কপি সেলফ-হেল্প বুক সরিয়ে শেলফ ফাঁকা করতে হবে, হায়দ্রাবাদে কোন্‌ বইয়ে কত ডিসকাউন্ট দিতে হবে, এইসব জানাত দিনের শেষে ইমেল করে।

“যা যা জানার আমি তো এখানে বসেই জেনে যাচ্ছি,” ও বলত। “সব আউটলেটের সেলস, স্টোর লেআউট, বাজারে বই বিক্রির ট্রেন্ড, সেনসাস, আরও যা যা আছে। বাকি কাজ তো কম্পিউটর করে।”

তারপর কী যে বোঝাল কিছুই বুঝলাম না, শুধু বুঝলাম যে ডেটা থেকে বই বিক্রির প্যাটার্ন ও আগে থেকে নিখুঁতভাবে ধরতে পারে।

আর কী অদ্ভুত ব্যাপার – ও যা যা বলত প্রায় প্রত্যেকটা জিনিস মিলে যেত। একশোবারে ভুল হত হয়ত মেরেকেটে তিনবার। যেদিন যখন যেখানে চাহিদা বাড়বে বা কমবে বলত প্রত্যেকটা অক্ষরে অক্ষরে মিলত। আমরা প্রতিবার ভাবতাম, এটা হতে পারে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওর কথাই ঠিক হত।

মিথ্যে বলব না, শম্বুক যখন ওর পার্ক্স বাড়িয়ে দিয়েছিল, খানিকটা হিংসেই হয়েছিল। যতই হোক্‌ আমি সিনিয়র। কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে বুঝতে পেরেছিলাম যে ও ডেস্কে বসে শম্বুকের জন্য যা করেছে আমার দ্বারা তার ছিটেফোঁটাও হবে না।

“ব্যাপারটা তুমি বুঝছ না,” আমাকে বুঝিয়েছিল একদিন। “দেখো, পুরোটাই ডিমান্ড আর সাপ্লাই, তাই না? যেখানে যখন ডিমান্ড সেখানে তখন সাপ্লাই দিতে না পারলে বিক্রি হবে কীভাবে? আমার একটা অ্যালগরিদম আছে, যেটা দিয়ে আমি বুঝতে পারি কখন কোথায় কীসের ডিমান্ড হতে চলেছে। চেষ্টা করি তিনদিন আগে জানানোর, ব্যাস্‌, আমার কাজ শেষ।”

“আর তাতে কাজ হয়?”

“হচ্ছে তো। হচ্ছে না?”

“কিন্তু এই অ্যালগরিদম সব ক্ষেত্রে খাটবে?”

“না না, আলাদা আলাদা প্যারামিটার তো। ধরো, তোমার একটা মেয়ের প্রতি ক্রাশ আছে। তুমি জানো মোটামুটি সে কখন ক্যান্টিনে আসে। এবার তুমি মোটামুটি সেই সময়টা যাওয়ার চেষ্টা করলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তুমি তাকে দেখতে পাবে। তুমি তোমার প্রেডিকশনে না বুঝেই ডেটা ব্যবহার করছ, তাই না? এবার যত বেশি ডেটা পাবে তুমি ক্রমশঃ আরও ভাল প্রেডিক্ট করতে পারবে, হয়ত এক সময় ঘড়ি ধরে মেলাতেও পারবে।”

“এটা সম্ভব?”

“কেন, তুমি কাউকে স্টক করতে চাও?”

*

বাদ সাধলেন অংশুমানবাবু, শম্বুকের ভাইস-প্রেসিডেন্ট। হার্ট অ্যাটাকের পর থেকে শমীক সোম অফিসে আসা বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে অংশুমানবাবুই কোম্পানির সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিলেন।

সমস্যা হল, সুজাতার প্রোমোশন ওখানেই আটকে ছিল। ওর ওপরে তখন শুধু ভিপি, আর সেই পোস্ট আটকে পড়ে ছিলেন অংশুমানবাবু। আর উনিও জানতেন সুজাতা প্রোমোশন চায়।

সেখান থেকেই দু’জনের মধ্যে ঝামেলার সূত্রপাত। বাড়তে বাড়তে চরমে পৌঁছল একদিন। সুজাতা কানপুর থেকে কয়েকটা বই দেরাদুনে সরাতে চেয়েছিল, অংশুমানবাবু সেটা আটকে দেন। দেরাদুনের আউটলেটে এসে নাকি লোকে খোঁজ করে ফিরে যায়।

সেদিন অফিসে সাংঘাতিক অশান্তি হয় দু’জনের মধ্যে। আর তারপর থেকে কথাবার্তা দূরে থাক, একেবারে দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ। ঐ, মিটিঙে যেটুকু।

আর তখন থেকেই কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায় সুজাতা। কাজে ফাঁকি দিত না ঠিকই, কিন্তু দুপুরের পর বোধহয় মনঃসংযোগে অসুবিধে হত। বিকেলের দিকে কখনও কখনও ডেস্ক ছেড়ে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে থাকত রাস্তার দিকে, হাতে নোটবুক। ফিরে এসে আবার কোড লিখতে বসত। আগে আগে পাঁচটার মধ্যে বেরিয়ে যেত, কিন্তু এখন ক্রমশঃ দেরি করতে শুরু করল।

আর অংশুমানবাবু যখন উঠে দাঁড়াতেন বেরোনোর জন্য (আগেই বলেছি, ঠিক পাঁচটা সাতাশে) তখন দেখার মত ব্যাপার হত। নোটবুক হাতে সোজা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত সুজাতা, যাতে মুখ দেখতে না হয়। অন্ততঃ দশ মিনিট না কাটিয়ে সিটে ফিরত না।

কয়েকদিন পর ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে উঠেছিল। তারপর অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।

*

তাই সেদিন যখন সুজাতা অংশুমানবাবুর ডেস্কে গিয়ে কথা বলল, খানিকটা অবাকই হয়েছিলাম। অশান্তি হয়নি। দুজনেরই আড়ষ্টতা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, তবে যা যা বলার মনে হয় সুজাতা গুছিয়ে বলতে পেরেছিল।

আমরা তটস্থ হয়ে বসে ছিলাম। ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলাম বারবার, কারণ পাঁচটা চুয়াল্লিশ ফসকালে অংশুমানবাবুর মেজাজ গরম অনিবার্য। তিন মিনিট সাতান্ন সেকেন্ড, আগেই বলেছি।

নিয়তি। ঐটুকু দেরি না হলে হয়ত অংশুমান দাশগুপ্তর অ্যাক্সিডেন্টটা হত না।

আর সেটা না হলে সুজাতাও আজ শম্বুকের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হত না।

যতই হোক, কপালের লিখন।

Friday, February 8, 2019

অলক্তার অসুখ


মূল গল্প: A Very Rare Disease
লেখক: Henry Slesar
অনুবাদ নয়, “ছায়া অবলম্বনে”

***

“তো, কী বলল ডাক্তার?

“কী আবার বলবে? এখন আমি পুরোপুরি ফিট।”

“ফিট তো বুঝলাম, কিন্তু হয়েছিলটা কী?”

“আরে, সে আর বলিস্‌ না। দাঁড়া, নামটা দেখে বলছি। এক মিনিট ধর্‌... এই যে... কা-স্টি-কো-নাই-স্টি-ভা-কা-নি-রা-গা-রি-সিস।”

“সে আবার কী?”

“কে জানে বাবা, আমি তো আগে নামও শুনিনি। ভারতবর্ষে নাকি এর আগে কারুর এ জিনিস হয়নি। ভাব্‌, এটা এত রেয়র যে কোনও উইকিপিডিয়া পেজ অবধি নেই।”

“তাহলে তোদের হল কীভাবে?”

“আমার কী মনে হয় জানিস্‌ শ্রীপর্ণা? এটা হয়েছে ঐ গত মাসে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে। ওখানেই হয়ত ছোঁয়াচ লেগে হয়েছে।”

“অসুখটা ঠিক কী বল্‌ তো?”

“এমনিতে কোনও সিম্পটম নেই। তারপর কয়েকমাস পর শুরু হয় অস্বস্তি, পেটের প্রবলেম, সর্দি-সর্দি ভাব, গা-হাত-পা ব্যথা, এইসব। মানে অস্বাভাবিক কিছু নয়। ধর্‌ তারপর তুই একদিন খানিকটা অধৈর্য হয়েই ডাক্তারের কাছে গেলি। তখন তুই জানতে পারবি। আর ততদিনে প্রায় সবকটা অর্গান ফেল করে গেছে, আর কোনও চান্স নেই। পুরো সাইলেন্টলি আসে।”

“মানে? তাহলে উপায়?”

“একমাত্র বাঁচতে পারিস্‌ যদি সময়মত ধরা পড়ে। আশিসের যেটা হয়েছিল। এমনিই চেকআপের জন্য ডাক্তাররের কাছে গেছিল, যায় বছরে একবার। উনিই দেখেটেখে বললেন কাস্টি – মানে, ঐ অসুখটা, খুব সিরিয়স, এক্ষুনি চিকিৎসা না হলে দেরি হয়ে যাবে।”

“কোন্‌ ডাক্তার?”

“আরে ঐ যে, ডঃ শুধাংশু রক্ষিত, উডল্যান্ডসে বসেন। শুনেটুনে যা বুঝলাম, ভারতবর্ষের কোনও ডাক্তারই কখনও সরাসরি এই অসুখটা হ্যান্ডল করেন নি।”

“তাহলে উনি?”

“কিন্তু ডঃ রক্ষিত অস্ট্রেলিয়ায় নাকি এটার সম্বন্ধে জানতে পারেন। এখানে এসে একটা কনফারেন্সে তিনি এটা নিয়ে বলেন। ওষুধও যা বুঝলাম গোটা দেশে একমাত্র ওঁর কাছেই আছে, অস্ট্রেলিয়া থেকেই আনিয়েছেন। সারতে অবশ্য সময় লাগেনি, কিন্তু ভয় পেয়েছিলাম সাংঘাতিক।”

“আমি এখনও একটু কনফিউজড। এটা ছড়ায় কীভাবে?”

“এমনিতে – ঐ আর কী, এইচআইভির মত, তবে ঐ, যেকোনও বডি কন্ট্যাক্ট থাকলেই ছড়ায়।”

“মানে? অস্ট্রেলিয়া তো তোরা দু’জনে গেছিলি, সেখানে গিয়ে আবার থার্ড কার সঙ্গে...?”

“আরে ধুর্‌, বললাম না? মোটামুটি অনেকক্ষণ বডি কন্ট্যাক্ট থেকেও হয়। আর আশিস্‌ ওয়াইল্ডলাইফ নিয়ে কাজ করে, ঐ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি। ডঃ রক্ষিত বললেন ঐ থেকেই। আর ওর থেকে আমার।”

“মানে জন্তুজানোয়ার থেকেও হয়?”

“তাই তো বললেন।”

“মারাত্মক।”

*

পরেরদিন বেলার দিকে উডল্যান্ডসে পৌঁছলেন অলক্তা। ডঃ সুধাংশু রক্ষিত বসেন এগারোটা থেকে একটা। সকালে ফোন করে তিনি জেনে নিয়েছেন বুকিংএর সময়। ওয়েটিংরুম থেকে খানিকটা দূরেই দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি, ডঃ রক্ষিতের দরজার ওপর চোখ রেখে।

এক সময় দরজা খুলল, আর সেলফোনে অন্যমনস্ক পেশেন্ট বেরিয়ে গেটের দিকে হাঁটা দিলেন। আর তখনই এগিয়ে এসে তাঁর গালে সপাটে চড় মারলেন অলক্তা।

“আমি জানতাম।” অলক্তার এই গলা অনেকদিন কেউ শোনেনি।

চড়টা আরেকটু পাশে পড়লে হয়ত ফার্স্টএড লাগত শ্রীপর্ণার। তবে অসুবিধে হত না, হাসপাতাল তো।

Tuesday, February 5, 2019

সেই গর্তটা



মূল গল্প: He-y, Come On Ou-t!
লেখক: Shinichi Hoshi
অনুবাদ নয়, “ছায়া অবলম্বনে”

***

জোতশিবরামপুর ছাড়িয়ে অনেকদূর গেলে মুজিবপাড়া বলে একটা গ্রামে একটা মঠ ছিল। একশো বছর আগে নাকি সেখানে জাগ্রত দেবতা না কীসব ছিল, কিন্তু কার পুজো হত সে কারুর মনে নেই। তারপরে ঝড়-ঝঞ্ঝা-ভূমিকম্প-মহামারী আরও কতকিছুর ধাক্কায় সেই মঠ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

তাই নিয়ে অবিশ্যি এত বছর কারুর মাথাব্যথা ছিল না। তবে সম্প্রতি জেলা পঞ্চায়েতের টনক নড়েছে। টুরিস্ট টানতে নানান্‌ ফন্দিফিকির আঁটছে তারা। এই মঠটাকে সাজিয়েগুছিয়ে রংচং মাখালে হয়ত কাজে দেবে।

*

গর্তটা প্রথম চোখে পড়ে মকরন্দ বোসের। মঠ থেকে মিটারদশেক দূরে একটা গর্ত, প্রায় নিখুঁত বর্গাকার চারফুট বাই চারফুট, ভেতরটা নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। জরিপের কাজে অনেক ঘুরেছেন তিনি, কিন্তু এইর’ম জিনিস বাপের জন্মে দেখেননি।

আশপাশের গ্রামেগঞ্জে খোঁজ করেও কিছু জানা গেল না। লাভের লাভ হল এই যে গর্ত ঘিরে হুজুগে বাঙালির ভিড় জমে গেল।

এই দিনের আলোতেও গর্তের ভেতরটা একেবারে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। কোনও শব্দও নেই, জল বা কিছুর। পাশে দাঁড়িয়ে লোকজন সম্পূর্ণ অকারণে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে লাগল।

“ভেতরে কে আছিস্‌, বেরিয়ে আয়!” গর্তের কিনারায় দাঁড়িয়ে বেশ নাটকীয়ভাবে চেঁচিয়ে উঠল এক উঠতি যুবক, তারপর নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠল। বিরক্ত হয়ে তাকালেন মকরন্দ বোস।

কেউ বলল শয়তানের বাসা, কেউ বলল ব্ল্যাকহোল। এক বৃদ্ধ বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানালেন দেবতার অভিশাপে হয়েছে, যদিও দেবতা খামোকা গর্ত খুঁড়তে যাবেন জিজ্ঞেস করায় তিনি চুপ করে রইলেন।

কিন্তু সেসব নাহয় হল, কী করা যায় এই গর্ত নিয়ে? ঢাকলে বা ঘিরে দিলেও বিপদ থেকেই যায়। তার থেকে বুজিয়ে দেওয়া ভাল।

তবে তার আগে বোঝা দরকার কতটা গভীর।

গর্তের কিনারায় দাঁড়িয়ে একবার চিৎকার করে উঠলেন মকরন্দ বোস। অভিজ্ঞ কান, প্রতিধ্বনি শুনে আর কিছু না হোক একটা মোটামুটি আন্দাজ করতে পারেন।

কিন্তু কীসের কী? কোথায় প্রতিধ্বনি?

এবার রাস্তা থেকে একটা ছোট্ট নুড়িপাথর কুড়িয়ে ছুঁড়ে দিলেন।

নাঃ, তাও সাড়া নেই।

ঠিক কতটা গভীর এই গহ্বর?

সঙ্গে যতগুলো দড়ি ছিল একসঙ্গে বেঁধে নামিয়ে দিলেন মকরন্দ বোস। কিন্তু এবারও তল পেলেন না।

*

পরেরদিন জেলাদপ্তর থেকে বাসে চড়ে ইয়া লম্বা লম্বা দড়ি সমেত উপস্থিত হলেন মকরন্দ বোসের সহকর্মীরা। দড়ির একদিক বাঁধলেন বাসের গায়ে, অন্যদিকে ভারি পাথর বেঁধে নামিয়ে দিলেন।

কিন্তু তাঁরাও তল পেলেন না।

অগত্যা ডাক পড়ল বিজ্ঞানদপ্তরের।

কিন্তু তাঁরাও ফেল মেরে গেলেন।

চোঙার মত দেখতে বিকট যন্ত্রপাতি দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভয়ানক জোরে নানান্‌ শব্দ করে কাক-চিল উড়িয়ে কুকুর তাড়িয়ে আশেপাশে সবার কানে তালা ধরিয়েও প্রতিধ্বনির ছিটেফোঁটাও পেলেন না তাঁরা।

টেকনিকাল কথা আদ্ধেক বুঝলেন না মকরন্দ বোস, শুধু বুঝলেন যে হবে না।

*

প্রথমে একটু গাঁইগুঁই করলেও রাজি হয়ে গেল গ্রাম পঞ্চায়েত। মঠটা যেখানে ছিল ঠিক সেখানে নয়, মুজিবপাড়ার একেবারে মাঝখানে বানিয়ে দেবেন মকরন্দ বোস, তাও বিনামূল্যে।

বিনিময়ে শুধু চেয়ে নিলেন গর্তটা। কেউ আপত্তি করেনি।

আর তারপরেই ছেড়ে দিলেন সরকারি চাকরিটা।

*

বছরপাঁচেকের মধ্যে মুজিবপাড়া হয়ে উঠল পশ্চিমবঙ্গের সবথেকে হাইপ্রোফাইল টুরিস্ট স্পট। এমনই তার রমরমা যে দমদম থেকে নিউইয়র্ক লন্ডন প্যারিস মেলবোর্ন টোকিও সর্বত্র রোজ ফ্লাইট শুরু হয়েছে।

আর মাঠ-খেত মাটিতে মিশিয়ে বানানো চল্লিশ লেনের হাইওয়ে দিয়ে দিনরাত শ’য়ে শ’য়ে ট্রাক চলে। তাতে করে আসে গোটা দেশের বর্জ্যপদার্থ – ঐ, চুরমার করে পিটিয়ে পিটিয়ে সাড়ে তিন ফুট বাই সাড়ে তিন ফুট বাক্সে আঁটানো।

ডলারে ইউরোয় ইয়েনে এখন মুজিবপাড়াকে চেনা দায়। জোতশিবরামপুর অবধি লাইন দিয়ে পাঁচতারা হোটেল, কারণ টুরিস্ট শুধু নয়, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের থাকার একটা জায়গা দিতে হবে তো!

হাইকোর্টের ফাইল থেকে পুরোনো প্রেমপত্র থেকে পরিত্যক্ত সেলফোন থেকে প্লাস্টিকের পাহাড় থেকে অপরাধের প্রমাণ, সবকিছুর আলাদা আলাদা রেট – আর তার সব যে আইন মেনে হয় তাও নয়।

তবে আসল টাকাটা আসে নিউক্লিয়র বর্জ্য থেকে। কোটি কোটি। আর আসবে নাই বা কেন?

যাই ফেলা হোক্‌ ঐ বুভুক্ষু গর্ত সব গিলে ফেলে, আর তাও হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হজম না করে ও খিদে বোধহয় মেটার নয়।

আর তার সেই হাঁয়ের সামনে সেলফি তোলার জন্য টিকিট কেটে লাইন দেয় বাচ্চা-বুড়ো-ছেলে-মেয়ে-নির্বিশেষে প্রত্যেকে।

সেই সেলফিতে জঞ্জাল থাকে না, কারণ অপ্রয়োজনীয় সব এখন চলে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে।

*

মুজিবপাড়া টাউনশিপের মেয়র এখন মকরন্দ বোস। ভোটের দরকার পড়েনি, কারণ আর কোনও প্রার্থী ছিল না। আজ তিনি খুশি। শোনা যাচ্ছে নোবেল শান্তি পুরস্কারটাও পেয়ে যেতে পারেন তিনি। টাকা বা ক্ষমতা অনেকেরই থাকে, কিন্তু এত বড় সম্মান?

শহরের ইন্ডাস্ট্রিও এখন ফুলেফেঁপে উঠেছে। বর্জ্যপদার্থ নিয়ে আর মাথা ঘামানোর দরকার নেই কারুর।

অপ্রয়োজনীয় অবাঞ্ছিত কোনওকিছুরই আর অস্তিত্ব নেই পশ্চিমবঙ্গে। শীগ্‌গিরি ভারতেও আর থাকবে না। তারপর গোটা পৃথিবীতে।

জানুয়ারির দুপুরে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালেন মকরন্দ বোস। এই ছাদটা মুজিবপাড়ার সবথেকে উঁচু জায়গা। চারপাশে অনেকগুলো তিরিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটতলা বাড়ি আছে বটে, কিন্তু এটার ধারেকাছেও নয় সেগুলো।

আকাশটা পাঁচবছর আগের মত নেই, না? অনেক ঝকঝকে হয়ে গেছে। সমুদ্রও তাই, দেখে এসেছেন তিনি।

এসব সাতপাঁচ ভাবছেন, আর তখনই আওয়াজটা ভেসে এল, অনেক, অনেক ওপর থেকে, বেশ নাটকীয় গলায়: “ভেতরে কে আছিস্‌, বেরিয়ে আয়!”

আর তারপরেই একটা গা-পিত্তি জ্বালানো হাসি।

বিরক্ত হয়ে তাকালেন মকরন্দ বোস, কিন্তু ওপর থেকে কীভাবে আওয়াজ আসতে পারে অনেক ভেবেও ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না।

Saturday, February 2, 2019

ক্লেপ্টোমেনিয়া

মূল গল্প: An Insignificant Crime
লেখক: Maxine O'Callaghan
অনুবাদ নয়, “ছায়া অবলম্বনে” লেখা।

***

“না অনির্বাণ, আটকাতে চেষ্টা কোরো না। আজ মেয়েটাকে আমি ধরবই।”

“সব জেনেও?”

“কী করব বলো? যেটা অন্যায় সেটা অন্যায়।”

“না দেখুন, আপনি জানেন যে উপায় আছে...”

“তুমি যেটাকে বলছ সেটা উপায় নয়। সেটা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। সেটা তুমিও জানো।”

“না, দেখুন, এটা তো আসলে একটা অসুখ, তাই না? আজকের কাগজেও বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। ডাক্তাররাও বলেছেন...”

“আমি জানি। কিন্তু অসুখের দোহাই দিয়ে তো সবকিছু চলতে পারে না, তাই না? আজ যদি আমি খুন করে বলি যে রোজ মানুষ না মারলে আমার রক্তচাপ বেড়ে যায়, তাহলে আইন সেটা মেনে নেবে?”

“দু’টো এক হল? এটা আর মানুষ খুন এক? এটা তো...”

“জানি। এটা সামান্য চুরি। এতে কারুর ক্ষতি হচ্ছে না, অন্ততঃ আমার তো হচ্ছেই না। কিন্তু যদি হত? যদি কাল কারুর ক্ষতি হয়?”

*

“আমার কন্যা রঞ্জিনী ক্লেপ্টোমেনিয়া রোগে আক্রান্ত। ডাক্তাররা বলিয়াছেন ইহার কোনওরূপ চিকিৎসা অসম্ভব। প্রমাণ সহযোগে এই নম্বরে ফোন করিলে সাধ্যমত ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব আমার।”

ইত্যাদি ইত্যাদি। সঙ্গে মেয়ের ছবি। আজকাল সাধুভাষা বোধহয় শুধু বিজ্ঞাপনে আর পাঁজিতেই চলে।

*

মালিকের সঙ্গে সেই কথাই হচ্ছিল। রঞ্জিনী মেয়েটা অনেকবার আমাদের দোকানে এসেছে। প্রতিবারই কিছু না কিছু তুলে নিয়ে গেছে। ওর বাবাকে জানালে দোকানের নামে সোজা ট্রান্সফার করে দিতেন। প্রমাণও লাগেনি কোনওদিন। আজকাল সেক্রেটারিকে বললেই হয়ে যায়। আর একশো-দু’শো টাকার জন্য কীই বা প্রমাণ চাইবেন?

সত্যি কথা বলতে কী, চাইতে আমারও অস্বস্তি হয়, কিন্তু মালিকের আদেশ। হিসেবে সমস্যা হয় নাকি।

তবে এবারে অতীনবাবু বেশ খেপে গেছেন। বলছি না সেটা অন্যায্য, বিশেষ করে ওঁর মত নীতিবাগীশ মানুষের পক্ষে। কিন্তু যতই হোক্‌, মেয়েটা অসুস্থ, একটু হয়ত...

কারুর কারুর মুখ দেখে বয়স বোঝা যায়। রঞ্জিনীকে দেখে মনে হয় কুড়ির পর আর বাড়েনি, যদিও আমি এখন জানি যে পঁয়ত্রিশ, মানে ঐ আমারই বয়সী।

মেয়েটার মুখের মধ্যে একটা অদ্ভুত নিষ্পাপ মায়াবী ভাব আছে। হয়ত সেই কারণেই সন্দেহ করতে ইচ্ছে করে না। আর সত্যিই তো, অসুস্থ তো, সত্যি সত্যি তো আর চোর নয়...

তবে ঐ, আমি ম্যানেজার হলেও কর্মচারীই, তার বেশি নই। আমি যতই বলি, মনে হয় না আজ ছেড়ে দেবেন।

*

আমাদের রায়চৌধুরী এম্পোরিয়মে ছ’টা সিসিটিভি ক্যামেরার তিনটে চলে, নয়ত খরচে পোষায় না। গোটা দু-তিন চালিয়ে ক্যাশ কাউন্টারের পাশে মনিটর চালু রাখলেই খদ্দের ভাবে যে সবকটা টিভি চলছে।

তবে আজ অতীনবাবু ছ’টাই চালাতে বলেছেন। মনে হচ্ছে আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বেন।

একটার পর একটা আইলে অলসভাবে হাঁটছিল রঞ্জিনী। একটা টর্চ তুলে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখে রেখে দিল। তারপর বোধহয় – ওটা কী? বাল্ব বোধহয়, না না, ওটাও রেখে দিল। তারপর আবার হাঁটতে লাগল, ইলেক্ট্রিকাল প্রডাক্টের সেকশন থেকে বেরিয়ে কিচেন অ্যাপ্লায়েন্সের দিকে...

*

স্পষ্ট দেখলাম একটা চামচের সেট তুলে শালের আড়ালে ঢোকাল রঞ্জিনী। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন অতীনবাবু, তবে ততক্ষণে আমার যা ভাবার ভাবা হয়ে গেছে। চাকরি গেলে যাবে, পুলিশ ডাকতে দেব না।

“আপনি যদি কিছু করেন আমি এখনই চাকরি ছেড়ে দেব।”

“তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?”

“না, ভয় দেখাচ্ছি না। ম্যানেজার আপনি পাবেন। আর আমিও চাকরি পাব। কিন্তু আমাকে এখানে আপনার দরকার।”

কথাটা ডাহা মিথ্যে, কারণ চাকরির যা বাজার, মনে হয় না কিছু জুটবে বলে।

“বাজে বোকো না। তুমি আসার আগেও রায়চৌধুরী এম্পোরিয়ম চলেছে, তুমি গেলেও চলবে।”

“হ্যাঁ, কিন্তু আপনি ভাবুন কী কী হারাবেন। এখানে চাকরি না করলে আমি কলকাতায় থাকব না, বাইরে চলে যাব।”

চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন অতীনবাবু।

“দেখুন, দোকানের ম্যানেজারকে বিয়ে করার পর থেকে আপনি মেয়েকে ক্ষমা করতে পারেন নি। এটা আমি জানি। আমি এও জানি মেয়ে-জামাই নিয়ে আপনার বিশেষ মাথাব্যথা নেই, তবে আমি গেলে আপনি নাতিকেও হারাবেন। নীতি আঁকড়ে টানতে পারবেন তো তখন বাকি জীবনটা?”

এখনও মুখ একই রকম থমথমে। কেলেঙ্কারি করলাম কিনা কে জানে। ভদ্রলোক খেদিয়ে দিলে কে চাকরি দেবে আর বৌ-বাচ্চাকে কী খাওয়াব কোনও ধারণা নেই।

“যা ভাল বোঝো করো।”

*

সন্ধ্যেবেলা সেক্রেটারি ভদ্রলোককে ফোন করলাম। অতীন রায়চৌধুরীর মেয়ে অতীন রায়চৌধুরীরই দোকান থেকে একশো টাকার চামচ নিয়েছে, তাই নিয়ে বলতে অস্বস্তি হচ্ছিল।

কিন্তু ঐ, কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম।

Followers