সবাই ঋতুপর্ণকে নিয়ে দিব্যি লিখে চলেছে, আমি বাদে। যা যা লেখার সব লেখা হয়ে গেছে, সমস্ত সিনেমা নিয়ে, গান নিয়ে, চিত্রনাট্য নিয়ে, 'হীরের আংটি' থেকে শুরু করে 'চোখের বালি', রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার থেকে প্রসেনজিতের আশ্চর্য বিবর্তন, নব্বইয়ের দশকের মুখ থুবড়ে পড়া বাংলা সিনেমাকে স্যালাইন-ট্যালাইন দিয়ে একটা মোটামুটি ভদ্রস্থ জায়গায় নিয়ে আসা, কিরণ খেরের ডাব্ড্ গলা এবং তাকে ঘিরে জাতীয় পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক - সবই হয়ে গেছে।
অমিতাভ-জয়া-অভিষেক-ঐশ্বর্য চারজনকেই পরিচালনা করার অদ্ভুত নজিরটা হয়ত এখনও কেউ খেয়াল করেনি, কিন্তু করতে দেরি নেই বোধহয় খুব একটা।
***
(সুকন্যা আর আমার ভাইয়ের কল্যাণে সম্প্রতি জানতে পেরেছি যে অভিষেক বচ্চন জোড়া টুইট করেছেন -
Just realised that Ritu da was the only director that my family have all worked with individually. Pa- last lear, Ma- sunglasses…
এবং
Aishwarya- choker bali, raincoat and me- Antarmahal
অভিষেকের কৃতিত্ব অভিষেক না কাড়লে আর কে কাড়বে?)
Just realised that Ritu da was the only director that my family have all worked with individually. Pa- last lear, Ma- sunglasses…
এবং
Aishwarya- choker bali, raincoat and me- Antarmahal
অভিষেকের কৃতিত্ব অভিষেক না কাড়লে আর কে কাড়বে?)
***
কিন্তু আপাততঃ সব বিষয়বস্তু শেষ। দেরিতে পৌঁছলে যা হয় আর কি - সবাই আগেই ঝপাঝপ্ সব লিখে ফেলেছে। সবকিছু কভার্ড, কিস্যু বাকি নেই। কয়েকটা লিঙ্ক না দিলে একটু অপরাধবোধ হচ্ছে, তাই আগে কর্তব্যটুকু সেরে ফেলি (চলচ্চিত্রকার বা পেশাদার সমালোচকদের বলা কথাগুলো আর দিলাম না, ধরে নিচ্ছি ওগুলো সবাই পড়েছে)।
এরা পাঁচজনে মিলে যেটুকু যা লেখার সব লিখে দিয়েছে, আমার আর কিছু লেখার বাকি থাকে না এরপর। তাই, অগত্যা, ঋতুপর্ণর সবথেকে কম আলোচিত সিনেমাগুলোর একটা নিয়ে লিখি বরং - যেটা নিয়ে লোকে বিশেষ মাথাটাথা ঘামায়নি বলেই আমার ধারণা (এই কথাটা পড়েই হয়ত লোকে মার্মার্কাট্কাট্ করে তেড়ে আসবে, কিন্তু সে আসুক্গে)।
***
সব চরিত্র কাল্পনিক প্রথমবার দেখেছিলাম আইনক্সে। সেদিন কোনোকারণে বেশ অন্যমনস্ক ছিলাম, বিশেষ মন দিয়ে দেখিনি। স্পষ্ট মনে আছে বিপাশা বসুর খ্যাস্খ্যাসে ডাব্ড্ গলা (পরে জেনেছি ওটা সোহিনী হালদারের গলা - কিন্তু তাতে আমার বিশেষণটা বদলাবে না) শুনে বেশ ঘাবড়ে গেছিলাম, যদিও এতদিনের অভ্যেসের পর চমকানোর বিশেষ যুক্তি ছিল না। ব্যাপারটা আরো অদ্ভুত লেগেছিল কারণ বিপাশার বেশিরভাগ সংলাপ ছিল ইংরিজিতে, আর বিপাশার ইংরিজি উচ্চারণ মোটেই বাজে নয় (বাংলা উচ্চারণ কেমন সেটা সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই)।
বিপাশা কিছুদিন পর যখন বিবৃতি দিয়েছিলেন যে ডাব্ করার দরকার ছিল না, আমার এই অভিযোগটা বেশ ঠিকঠাক মনে হয়েছিল। সত্যি বলতে কি, চিরঞ্জিতের গলায় সব্যসাচী (বাড়িওয়ালি) এবং ঋতুপর্ণ ঘোষের অনেক সিনেমার আরো নানান্ ডাবিংএর রহস্যভেদ আমি কখনওই করে উঠতে পারিনি।
যাক্গে, বড় বড় লোকেদের বড় বড় ব্যাপার বোঝার মত বুদ্ধি আমার নেই। আমি নিশ্চিত যে 'সত্যান্বেষী' মুক্তি পেলে খারাপই হবে। ব্যোমকেশ বক্সী বেঁটে হলে সে সিনেমা দেখার যোগ্য হবে না। যত বড়ই অভিনেতা হোন্, পঙ্কজ কপূর ফেলুদা হলে জমত?
ইন্টারনেট ঘেঁটে পাওয়া ছবি |
(গুরুত্বপূর্ণ তথ্য - বিদ্যা বালনের উচ্চতা পাঁচ ফীট চার ইঞ্চি।)
যাক্গে, মূল বক্তব্যে আসি। সব চরিত্র কাল্পনিক দেখে (এবং দেখে বিশেষ সুবিধের না লাগার পর) একটা ছোট্ট অপরাধবোধে ভুগছিলাম। নানান্ সূত্রে সিনেমাটা সংগ্রহ করে গত কয়েক বছরে কয়েকবার দেখে ফেলেছি। আর দেখে বুঝেছি, পপকর্ন খেতে খেতে পেছনের সীটের ছিঁচকাঁদুনে অবাঙালি শিশুর চিৎকার শুনতে শুনতে আর লাথি খেতে খেতে দেখাটা মোটেই উচিত হয়নি।
লম্বা ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে আসল বক্তব্যটুকু সেরে ফেলি; সব চরিত্র কাল্পনিক নিঃসন্দেহে ঋতুপর্ণর সবথেকে, আন্ডাররেটেড সিনেমা। সেরা সিনেমাই বলে ফেলতাম (হ্যাঁ, যীশু সেনগুপ্ত থাকা সত্ত্বেও), কিন্তু কীর'ম একটা বাধছে, মূলতঃ আমি ঋতুপর্ণর সব সিনেমা দেখিনি বলেই (এমন কি চিত্রাঙ্গদাও না)।
আমি সিনেমাটিনেমা বিশেষ বুঝি না। আমার সীমিত বুদ্ধিতে বলে, সিনেমা তিন রকমের - ভাল, খারাপ, আর কান্তি শাহ্র সিনেমা। আর সেই সংজ্ঞা মেনে সব চরিত্র কাল্পনিক হল একটা ভাল সিনেমা। একটা রীতিমত ভাল সিনেমা।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। যে আমি সারা জীবনে সুকুমার রায় বাদ দিয়ে সাকুল্যে হয়ত পঞ্চাশটা কবিতাও পড়িনি (যা পড়েছি তারও বেশিরভাগই রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ), তার হঠাৎ সব চরিত্র কাল্পনিক এত ভাল লাগার যুক্তি কী (বিশেষতঃ যেখানে সিনেমাটা আদ্যোপান্ত কবিতানির্ভর)?
বিশেষতঃ যেখানে সিনেমাটা ঠিক ফীল-গূড বলতে যা বোঝায় তা নয়। আগেই বলেছি, সব চরিত্র কাল্পনিক পপকর্ন খেতে খেতে দেখেছি, কিন্তু দোসর বা দ্য লাস্ট লিয়রও সেভাবেই দেখেছি, কাজেই সেটা কোনো যুক্তি নয়।
আমার মানসিকতার সঙ্গে সব চরিত্র কাল্পনিক-এর মিলও নেই বিশেষ। আমি টুকটাক লিখি, কিন্তু তার মধ্যে বিশেষ গভীরতা নেই, সর্যিয়ল জিনিসপত্র বুঝিটুঝি না, কিছু মোটা দাগের রসিকতাকে ভাল বলে চালানোর চেষ্টা করে নানান্ ব্লগপোস্ট লিখি। আমি নেহাৎই গদ্যপন্থী, কবিতা-টবিতা আমার নাগালের বাইরেই থাকবে আজীবন; ডোরেমন দেখেটেখে বড়জোর নবিতা অবধি দৌড় আমার।
অনেকেই বলেছে পর্দায় জয় গোস্বামীকে আবৃত্তি করতে দেখে তাদের গায়ে রীতিমত কাঁটা দিয়েছে। আমার মোটেই এসব হয়নি।
তাহলে ব্যাপারটা কী?
গুছিয়ে বলার চেষ্টা করি, যদিও ঘেঁটে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা আছে।
সিনেমা আর কবিতা দুটোই মারাত্মক শক্তিশালী মাধ্যম। কোন্টার জোর বেশি বলা কঠিন, তাও যেহেতু আমি কবিতাটবিতা বিশেষ বুঝি না, আমার পাল্লা সিনেমার দিকে অনেক বেশি ভারি। আমি নিশ্চিত যে অনেকে উল্টোটা বলে বসবে।
তবে একটা বিষয়ে সবাই একমত হবে - দুটো মাধ্যমের মধ্যে আকাশপাতাল পার্থক্য আছে। গড়পরতা সিনেমার মুখ্য উদ্দেশ্য দৃশ্যের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছনো। সিনেমা মানুষকে দেখতে সাহায্য করে, দর্শক দেখতে না চাইলেও তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যাতে সে মিস্ না করে।
বেশিরভাগ কবিতার উদ্দেশ্য এর ঠিক উল্টো। তারা দৃশ্য বোনে না - তারা শুধু কিছু অনুভূতি আর শব্দ ছুঁড়ে দেয়, দৃশ্য গড়ে নেওয়ার দায়িত্ব হয়ে ওঠে পাঠকের নিজেদের।
তা বলে কি সিনেমার অন্তর্নিহিত অর্থ নেই? আলবাৎ আছে। কিন্তু শুধুই অর্থটুকু - দৃশ্যটা তো দর্শক রক্তমাংসের চোখেই দেখছে। কবিতা একটা জোড়া চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় - আগে তো যেটা দেখানোর চেষ্টা করছে সেটা দেখো (কোনো নিশ্চয়তা নেই ঠিকঠাক দেখতে পেলে কিনা), তারপর, যদি ধক্ থাকে তো বোঝার চেষ্টা করো।
সম্ভবতঃ এইজন্যই কবিতা সিনেমার মত অত জনপ্রিয় মাধ্যম নয়। কবিতার ঐ ভারি, মোটা, কালো, শক্ত, লোহার চাবিটা এইজন্য আমার মত নিরীহ সাধাসিধে ইন্টেলেকচুয়ল সেজে থাকা লোকেদের আওতার বাইরেই থাকবে।
না, ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি না। সব চরিত্র কাল্পনিক-এর ইমোশনল সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি ঐখানেই - কবিতা আর সিনেমার একটা একটা সাবলীল মেলবন্ধন। কখন কীভাবে সিনেমা কবিতায়, বা কবিতা সিনেমায় মিশেছে বুঝে ওঠার আগেই সব ওলটপালট হয়ে যায় - দুটো মাধ্যমকে কোনোভাবেই একে অন্যের থেকে আলাদা করা যায় না।
সব চরিত্র কাল্পনিক-এ ঋতুপর্ণ (না, এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না) পর্দায় কবিতা আঁকতে সক্ষম হয়েছেন। সেই কবিতার বিষয়বস্তু আবার কবিতা - আর এই দ্বিতীয় স্তরের কবিতাকে ফুটিয়ে তুলতে, রক্তমাংসের চেহারা দিতে উনি আবার ব্যবহার করেছেন সিনেমাকে।
***
(ওপরের অনুচ্ছেদটা যদি দু'তিনবার পড়েও না বোঝা যায়, তাহলে সেটা আমার দোষ নয়; সে দোষ স্বয়ং ঋতুপর্ণর।)
***
আমি কি ইন্দ্রনীল মিত্র? না। আমি ইন্দ্রনীল মিত্র নই। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায়ও আমার নেই যে খানিকটা ইন্দ্রনীল মিত্র আমার মধ্যে ঢুকে বসে আছে। তবে সেটা হয়ত অল্পবিস্তর সবার মধ্যেই আছে - বিশেষতঃ যেখানে বাঙালির মজ্জায় ঢুকে গেছে যে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, লাল চোখ, ঘুমভাঙা গলাসর্বস্ব শিল্পী মানেই তার সাত খুন মাপ।
আর এইখানে সব চরিত্র কাল্পনিক আবার বাজিমাত করেছে। ইন্দ্রনীলের ভাবনার গভীরতা এবং ব্যাপ্তি দুটোই মারাত্মক স্তরের, কিন্তু ব্যক্তিগত রোজকার জীবনে সে একেবারেই মার্কামারা বাঙালি কবির মতই অপদার্থ। কিন্তু প্রলোভন সত্ত্বেও ঋতুপর্ণ নৈর্ব্যক্তিক থেকেছেন, ইন্দ্রনীলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেননি, দর্শকের সহানুভূতি বরং রাধিকার দিকেই ঝুঁকেছে। মজার ব্যাপার, ইন্দ্রনীলের কবিসত্তাকে কিন্তু ঋতুপর্ণ আদৌ ছোট করেননি চিত্রনাট্যে - বরং ব্যক্তিগত আর পেশাদার জীবনের অদ্ভুত কন্ট্রাস্টকে বেশ সাবলীলভাবে দেখিয়েছেন।
এছাড়া আছে ট্রেন। এ ট্রেন পথের পাঁচালীর ট্রেন নয়, সম্পূর্ণ অন্য ফ্লেভর। প্রায় প্রত্যেকটা শট ট্রেনের ভেতর থেকে নেওয়া, আর চিত্রনাট্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আশ্চর্যরকমের প্রতীকী। রাধিকার জীবনের অনন্ত যাত্রার সঙ্গে তাল রেখে ছুটে চলা ট্রেন সিনেমার একটা দ্বিতীয় ন্যারেটিভ।
তার মধ্যে আছে কবিতা (যা আমি বুঝি না, তবে কেউ দরাজ গলায় আবৃত্তি করলে নেহাৎ মন্দ লাগে না); আছে নন্দর মা প্রিয়বালাকে নিয়ে লেখা সেই আশ্চর্য কবিতা, যেটা শুনলে আমার মত বেরসিকেরও পেটের ভেতরটা খালি-খালি লাগে।
তার সঙ্গে আছে অতীত-বর্তমান-সর্যিয়ল একাকার করে দেওয়া চিত্রনাট্য - যে চিন্তাধারা বাঙালি পরিচালকের হাতের মুঠোর বাইরেই ছিল এতদিন; টাইম ওয়র্প নিয়ে ভাবনাচিন্তা হয়ত হয়েছে, কিন্তু হলেও তা এত আধুনিক নয়, আর যদি আধুনিকও হয়ে থাকে তাহলে অন্ততঃ এত কাব্যিক নয়।
আর আছে কাজরী রায়। কাজরী রায় হতেই পারত বনলতা সেন বা নীরা, কিন্তু সে আরও নিখুঁত; সে হয়ত বাস্তবই নয়; শুধু ইন্দ্রনীল নয়, সমস্ত পুরুষ খুঁজে মরেছে তাকে। কাজরী রায় নারী - দূরত্ব ও সময়ের বাধা পেরিয়ে যে আগুনে পুরুষ যুগ যুগ ধরে পতঙ্গের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছে, সেই নারী।
কাজরী ইন্দ্রনীলের নারী, তার প্রেমিকা, তার শয্যাসঙ্গিনী, হয়ত তার মা-ও, কিন্তু ইন্দ্রনীলের যাবতীয় খিদে সত্ত্বেও সে কামনাই থেকে গেছে, ধরা দেয়নি। রাধিকা কাজরী হতে চেয়েছে, হয়ত বা নিজের অজান্তে হয়েও উঠেছে কখনও, বা হয়নি - কিন্তু ইন্দ্রনীল অধরাই থেকে গেছে তার কাছে।
আর তারপর, যখন রাধিকা আবিষ্কার করে যে ইন্দ্রনীলের কবিতা আদতে তার নিজেরই কবিতার অবলম্বনে লেখা, প্রথমে রেগে গেলেও সে ক্রমশঃ উপলব্ধি করে যে ইন্দ্রনীলের কবিতার অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিল সে নিজে।
আর তাই, তারপর - সব শেষ হওয়ার পর - বাস্তব-কল্পনার সীমারেখায় দাঁড়িয়ে থাকা কাজরীর সঙ্গে বেডকভার পাট করতে তাই রাধিকার আটকায় না কোথাও; কাজরীর সাবলীল স্পর্শে আদরে রাধিকা তাই স্বচ্ছন্দ; কখনও সে নিজেই হয়ে ওঠে কাজরী - আর কখনও কাজরীর সঙ্গে মিলে সে জয় করতে চায় ইন্দ্রনীলকে। তখন আর শেখরের অস্তিত্ব নিয়ে কে ভাবে?
রাধিকা তখন বারবার অতীতে ফিরে যায়, বারবার বুঝতে চায় একঘেয়ে দৈনন্দিন ঘটনাগুলো থেকে ইন্দ্রনীলের কবিতা কীভাবে খুঁজে পেত কবিতার উৎস; রাধিকা ক্রমশঃ উপলব্ধি করে তাদের সম্পর্কের, যৌনতার সার্থকতা, গভীরতা - যা ইন্দ্রনীল বুঝলেও রাধিকা কখনও বুঝে উঠতে পারেনি।
আর এখানেই ঋতুপর্ণর জিত। রক্তমাংসের চরিত্রের সঙ্গে কল্পনার মিলনকে শুধু নয়, একাকার হয়ে যাওয়াকেও সম্ভব করে দেখিয়েছেন সব চরিত্র কাল্পনিক-এ। বাঙালি এ জিনিস কবিতায় দেখেছে, কিন্তু সিনেমায় দেখেনি - হয়ত ভাবেওনি দেখার কথা।
আমার মানসিকতার সঙ্গে সব চরিত্র কাল্পনিক-এর মিলও নেই বিশেষ। আমি টুকটাক লিখি, কিন্তু তার মধ্যে বিশেষ গভীরতা নেই, সর্যিয়ল জিনিসপত্র বুঝিটুঝি না, কিছু মোটা দাগের রসিকতাকে ভাল বলে চালানোর চেষ্টা করে নানান্ ব্লগপোস্ট লিখি। আমি নেহাৎই গদ্যপন্থী, কবিতা-টবিতা আমার নাগালের বাইরেই থাকবে আজীবন; ডোরেমন দেখেটেখে বড়জোর নবিতা অবধি দৌড় আমার।
অনেকেই বলেছে পর্দায় জয় গোস্বামীকে আবৃত্তি করতে দেখে তাদের গায়ে রীতিমত কাঁটা দিয়েছে। আমার মোটেই এসব হয়নি।
তাহলে ব্যাপারটা কী?
গুছিয়ে বলার চেষ্টা করি, যদিও ঘেঁটে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা আছে।
সিনেমা আর কবিতা দুটোই মারাত্মক শক্তিশালী মাধ্যম। কোন্টার জোর বেশি বলা কঠিন, তাও যেহেতু আমি কবিতাটবিতা বিশেষ বুঝি না, আমার পাল্লা সিনেমার দিকে অনেক বেশি ভারি। আমি নিশ্চিত যে অনেকে উল্টোটা বলে বসবে।
তবে একটা বিষয়ে সবাই একমত হবে - দুটো মাধ্যমের মধ্যে আকাশপাতাল পার্থক্য আছে। গড়পরতা সিনেমার মুখ্য উদ্দেশ্য দৃশ্যের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছনো। সিনেমা মানুষকে দেখতে সাহায্য করে, দর্শক দেখতে না চাইলেও তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যাতে সে মিস্ না করে।
বেশিরভাগ কবিতার উদ্দেশ্য এর ঠিক উল্টো। তারা দৃশ্য বোনে না - তারা শুধু কিছু অনুভূতি আর শব্দ ছুঁড়ে দেয়, দৃশ্য গড়ে নেওয়ার দায়িত্ব হয়ে ওঠে পাঠকের নিজেদের।
তা বলে কি সিনেমার অন্তর্নিহিত অর্থ নেই? আলবাৎ আছে। কিন্তু শুধুই অর্থটুকু - দৃশ্যটা তো দর্শক রক্তমাংসের চোখেই দেখছে। কবিতা একটা জোড়া চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় - আগে তো যেটা দেখানোর চেষ্টা করছে সেটা দেখো (কোনো নিশ্চয়তা নেই ঠিকঠাক দেখতে পেলে কিনা), তারপর, যদি ধক্ থাকে তো বোঝার চেষ্টা করো।
সম্ভবতঃ এইজন্যই কবিতা সিনেমার মত অত জনপ্রিয় মাধ্যম নয়। কবিতার ঐ ভারি, মোটা, কালো, শক্ত, লোহার চাবিটা এইজন্য আমার মত নিরীহ সাধাসিধে ইন্টেলেকচুয়ল সেজে থাকা লোকেদের আওতার বাইরেই থাকবে।
না, ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি না। সব চরিত্র কাল্পনিক-এর ইমোশনল সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি ঐখানেই - কবিতা আর সিনেমার একটা একটা সাবলীল মেলবন্ধন। কখন কীভাবে সিনেমা কবিতায়, বা কবিতা সিনেমায় মিশেছে বুঝে ওঠার আগেই সব ওলটপালট হয়ে যায় - দুটো মাধ্যমকে কোনোভাবেই একে অন্যের থেকে আলাদা করা যায় না।
সব চরিত্র কাল্পনিক-এ ঋতুপর্ণ (না, এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না) পর্দায় কবিতা আঁকতে সক্ষম হয়েছেন। সেই কবিতার বিষয়বস্তু আবার কবিতা - আর এই দ্বিতীয় স্তরের কবিতাকে ফুটিয়ে তুলতে, রক্তমাংসের চেহারা দিতে উনি আবার ব্যবহার করেছেন সিনেমাকে।
***
(ওপরের অনুচ্ছেদটা যদি দু'তিনবার পড়েও না বোঝা যায়, তাহলে সেটা আমার দোষ নয়; সে দোষ স্বয়ং ঋতুপর্ণর।)
***
আমি কি ইন্দ্রনীল মিত্র? না। আমি ইন্দ্রনীল মিত্র নই। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায়ও আমার নেই যে খানিকটা ইন্দ্রনীল মিত্র আমার মধ্যে ঢুকে বসে আছে। তবে সেটা হয়ত অল্পবিস্তর সবার মধ্যেই আছে - বিশেষতঃ যেখানে বাঙালির মজ্জায় ঢুকে গেছে যে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, লাল চোখ, ঘুমভাঙা গলাসর্বস্ব শিল্পী মানেই তার সাত খুন মাপ।
আর এইখানে সব চরিত্র কাল্পনিক আবার বাজিমাত করেছে। ইন্দ্রনীলের ভাবনার গভীরতা এবং ব্যাপ্তি দুটোই মারাত্মক স্তরের, কিন্তু ব্যক্তিগত রোজকার জীবনে সে একেবারেই মার্কামারা বাঙালি কবির মতই অপদার্থ। কিন্তু প্রলোভন সত্ত্বেও ঋতুপর্ণ নৈর্ব্যক্তিক থেকেছেন, ইন্দ্রনীলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেননি, দর্শকের সহানুভূতি বরং রাধিকার দিকেই ঝুঁকেছে। মজার ব্যাপার, ইন্দ্রনীলের কবিসত্তাকে কিন্তু ঋতুপর্ণ আদৌ ছোট করেননি চিত্রনাট্যে - বরং ব্যক্তিগত আর পেশাদার জীবনের অদ্ভুত কন্ট্রাস্টকে বেশ সাবলীলভাবে দেখিয়েছেন।
এছাড়া আছে ট্রেন। এ ট্রেন পথের পাঁচালীর ট্রেন নয়, সম্পূর্ণ অন্য ফ্লেভর। প্রায় প্রত্যেকটা শট ট্রেনের ভেতর থেকে নেওয়া, আর চিত্রনাট্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আশ্চর্যরকমের প্রতীকী। রাধিকার জীবনের অনন্ত যাত্রার সঙ্গে তাল রেখে ছুটে চলা ট্রেন সিনেমার একটা দ্বিতীয় ন্যারেটিভ।
তার মধ্যে আছে কবিতা (যা আমি বুঝি না, তবে কেউ দরাজ গলায় আবৃত্তি করলে নেহাৎ মন্দ লাগে না); আছে নন্দর মা প্রিয়বালাকে নিয়ে লেখা সেই আশ্চর্য কবিতা, যেটা শুনলে আমার মত বেরসিকেরও পেটের ভেতরটা খালি-খালি লাগে।
তার সঙ্গে আছে অতীত-বর্তমান-সর্যিয়ল একাকার করে দেওয়া চিত্রনাট্য - যে চিন্তাধারা বাঙালি পরিচালকের হাতের মুঠোর বাইরেই ছিল এতদিন; টাইম ওয়র্প নিয়ে ভাবনাচিন্তা হয়ত হয়েছে, কিন্তু হলেও তা এত আধুনিক নয়, আর যদি আধুনিকও হয়ে থাকে তাহলে অন্ততঃ এত কাব্যিক নয়।
আর আছে কাজরী রায়। কাজরী রায় হতেই পারত বনলতা সেন বা নীরা, কিন্তু সে আরও নিখুঁত; সে হয়ত বাস্তবই নয়; শুধু ইন্দ্রনীল নয়, সমস্ত পুরুষ খুঁজে মরেছে তাকে। কাজরী রায় নারী - দূরত্ব ও সময়ের বাধা পেরিয়ে যে আগুনে পুরুষ যুগ যুগ ধরে পতঙ্গের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছে, সেই নারী।
কাজরী ইন্দ্রনীলের নারী, তার প্রেমিকা, তার শয্যাসঙ্গিনী, হয়ত তার মা-ও, কিন্তু ইন্দ্রনীলের যাবতীয় খিদে সত্ত্বেও সে কামনাই থেকে গেছে, ধরা দেয়নি। রাধিকা কাজরী হতে চেয়েছে, হয়ত বা নিজের অজান্তে হয়েও উঠেছে কখনও, বা হয়নি - কিন্তু ইন্দ্রনীল অধরাই থেকে গেছে তার কাছে।
আর তারপর, যখন রাধিকা আবিষ্কার করে যে ইন্দ্রনীলের কবিতা আদতে তার নিজেরই কবিতার অবলম্বনে লেখা, প্রথমে রেগে গেলেও সে ক্রমশঃ উপলব্ধি করে যে ইন্দ্রনীলের কবিতার অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিল সে নিজে।
আর তাই, তারপর - সব শেষ হওয়ার পর - বাস্তব-কল্পনার সীমারেখায় দাঁড়িয়ে থাকা কাজরীর সঙ্গে বেডকভার পাট করতে তাই রাধিকার আটকায় না কোথাও; কাজরীর সাবলীল স্পর্শে আদরে রাধিকা তাই স্বচ্ছন্দ; কখনও সে নিজেই হয়ে ওঠে কাজরী - আর কখনও কাজরীর সঙ্গে মিলে সে জয় করতে চায় ইন্দ্রনীলকে। তখন আর শেখরের অস্তিত্ব নিয়ে কে ভাবে?
রাধিকা তখন বারবার অতীতে ফিরে যায়, বারবার বুঝতে চায় একঘেয়ে দৈনন্দিন ঘটনাগুলো থেকে ইন্দ্রনীলের কবিতা কীভাবে খুঁজে পেত কবিতার উৎস; রাধিকা ক্রমশঃ উপলব্ধি করে তাদের সম্পর্কের, যৌনতার সার্থকতা, গভীরতা - যা ইন্দ্রনীল বুঝলেও রাধিকা কখনও বুঝে উঠতে পারেনি।
আর এখানেই ঋতুপর্ণর জিত। রক্তমাংসের চরিত্রের সঙ্গে কল্পনার মিলনকে শুধু নয়, একাকার হয়ে যাওয়াকেও সম্ভব করে দেখিয়েছেন সব চরিত্র কাল্পনিক-এ। বাঙালি এ জিনিস কবিতায় দেখেছে, কিন্তু সিনেমায় দেখেনি - হয়ত ভাবেওনি দেখার কথা।
Cinema ta dekhini... tai beshi kichhu bolchhi na... lekhata anyo rokom!!
ReplyDeleteসিনেমাটা চট্পট্ দেখে ফেল্।
Deleteআমার পড়া তোমার সবথেকে ভাল লেখা (জানিনা এখন তোমার আমাকে “তেড়ে মেরে ডাণ্ডা, করে দিই ঠাণ্ডা” টাইপ কিছু ইচ্ছে করছে কি না। তবে, সত্যি বলছি, তোমার অনেক লেখা আমার বেশ কঠিন লাগে।) এই লেখাটা সহজে বুঝলাম, ভাল লাগল। হয়ত আমিও ছবিটার কবিতা-টা, আর সেই কবিতার কল্পনা-টা - খানিক এইরকম করেই বুঝেছি বলে, বা হয়ত বিনাকারনেই।
ReplyDeleteধন্যবাদ। খামোকা মারতে যাব কেন?
Deleteকোন্ লেখাগুলো কঠিন লাগে জানাস্। আমার লেখা সম্পর্কে আমি অনেক সমালোচনা পেয়েছি, কিন্তু 'কঠিন' তার মধ্যে পড়ে না। জানাস্ কিন্তু।
kichu to bola baki chilo abhishekda and you said that so beautifully. Agree with you completely, every frame in the film was a poem and I just loved how effortlessly he blended the imaginary and the real worlds.
ReplyDeleteনা রে দেবলীনা, আমার লিখে ঠিক তৃপ্তি হল না। মনে হল অনেক কিছু বলা বাকি থেকে গেল।
Deleteamio kintu ei cinemata onekbar dekhechii..keno je dekhechi janina..tobe pore jeno mone holo hoyto ei karon guloi..
ReplyDeleteএই সিনেমাটা একটা নেশার মত সুমনা। আর সবথেকে মজার কথা, যতবার দেখি একটা নতুন স্তর আবিষ্কার করি।
Deleteশেষবারে দেখলাম সিনেমার শুরুতে দুধের গ্লাস, যেটা বারবার আমার চোখ এড়িয়ে গেছে। কেন যে বুঝিনি ওটা রাধিকার স্কুলজীবন দেখানোর জন্য, আমি জানি না। হয়ত প্রথম দৃশ্য বলেই মন দিইনি।
Aamar bheeshon mon kharap. Bheeshon Bheeson mon kharap holo eta pore :( Eta baje typer bhalo lekha.
ReplyDeleteএটা ভাল বললি না খারাপ?
Deleteparama bodh hoy 'bishri bhalo' type er kichu bolte cheyechhe :P jokes apart, lekha ta bhalo hoyechhe. film ta, puro ta dekhe uthte parini. bipasha'r dubbed dialogues acoustically khub jarring.
Deleteআমারও প্রথমবারে ঐ একই অবস্থা হয়েছিল। লিখেওছিলাম। কিন্তু ঐটুকু (আর অবশ্যই যীশু সেনগুপ্তকে) সহ্য করতে পারলে সিনেমাটা শুধু অসাধারণ নয়, বৈপ্লবিকও।
Deleteতিনি এগিয়ে দেরী পরিচালক এর উত্তরাধিকার গ্রহণ করা হবে.
ReplyDeleteDhari
Dhari, will you please stop using Google Translate? It really doesn't work for Bangla.
DeleteOuch :(
DeleteSorry Dhari.I guess I owe you an apology.
Hello, Google Translate. Nice knowing you.
DeleteThank you Abhishek.But for me to know you better,can you please not write in Bengali?
DeleteI try to write in English as much as I can, but some thoughts and emotions - I hope you'll agree - really cannot be translated.
DeleteI typically use the language I think in. In most cases it's English, but in some others it has to be Bangla.
Babu,i think you should write in english here.
DeleteFor bangla,you should start a separate blog :)
Given that it's my blog, I guess I ought to be the one who would decide what I 'should' do here, isn't it?
DeleteAbhishekda,I had asked you to remove anonymous option in the past.Look now,somebody has posted comments using my name.
DeleteThe real Dhari.
If regular visitors like you actually use your IDs to log in, I will remove the anonymous comment option forever. It's a promise.
DeleteBipasha r gola khoob sundor, amar darun lagey.
ReplyDeleteআমারও বিপাশার গলা অসাধারণ লাগে। যৌন আবেদন সাংঘাতিক।
Deleteyou mean 'sexy', right?
Deleteতুই কীর'ম একটা। কোনো সূক্ষ্মতাবোধ নেই।
DeleteBhalo hoychhe
ReplyDeleteধন্যবাদ।
Delete"সিনেমা মানুষকে দেখতে সাহায্য করে, দর্শক দেখতে না চাইলেও তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যাতে সে মিস্ না করে।"
ReplyDelete- সবসময় নয় মনে হয়, জ্যাঠা এ নিয়ে কি যেন ভারী ভারী কথা বলেছিল...বাদবাকি সব একদম একমত, দারুণ লাগলো পড়ে।
বাংলায় বেশি লেখোনা কেন? বেশি লোকে পড়েনা বলে?
না সুনন্দ, সেটা ব্যাপার নয়। আসলে যে ভাষায় ভাবি, সেই ভাষাতেই লিখি।
Deleteবড্ড সুন্দর করে লিখেছিস... দেখেছি সিনেমা টা, কিন্তু এভাবে ভাবিনি কখনও।
ReplyDeleteআমার মত করে আর কে ভাবে বলো? :)
Deleteosadharon!
ReplyDeleteধন্যবাদ!
Deletetumi banglateo soman dokkho jotota english e !! sense of humour e bhorti !!
ReplyDeleteবাপ রে! অজস্র ধন্যবাদ!
Deleteঅনেক ধন্যবাদ! এই ছবিটা কেন অসাধারণ সেটা লোককে বোঝানোর চেষ্টা করে করে হয়রান হয়ে গেছি। এবার থেকে স্রেফ এই লেখাটা বাড়িয়ে দোবো।
ReplyDeleteবিপুলা এ পৃথিবীতে ইংরিজিতে ঢের ঢের ব্লগ লেখা হয়, আপনি মাঝেমধ্যে বাংলায় লিখলে পড়ে চাট্টি সুখ পাই। মাঝেমধ্যে হলেই চলবে। বাকিগুলো লিখুন না হয় ম্লেচ্ছভাষায়। :)
আপনার কথা মনে রাখব। তবে হ্যাঁ, জেনে ভাল লাগল যে আপনি 'সব চরিত্র কাল্পনিক'এর মর্ম বুঝেছেন।
Deleteঋতুপর্ণর ছবিতে খুব সংলাপ, আকাশবাতাস ভরে কথার প্লাবন। সব ভালোলাগার উপরেও এই কথাটা ভেসে থাকে। এই ছবিটা দেখতে বসে কথার প্রাচুর্যে সমস্যা হয় না, বরং সেই কথামালা কবিতার চেহারা নিয়ে ছবিটাকে সার্থক ক'রে তোলে। এমনটা আমার মত।
Deleteএমনটা আমারও মত, তবে সব ছায়াছবির ক্ষেত্রে নয়।
Delete