মূল গল্প: Action Will be
Taken
লেখক: Heinrich Boll
অনুবাদ নয়, “ছায়া অবলম্বনে”
----
ইন্ট্রোফার্ম এন্টারপ্রাইজের ঐ তিনটে বছর ছিল আমার জীবনে সবথেকে
ঘটনাবহুল। আসলে ওদের ব্যাপারটাই আলাদা।
এই যেমন ইন্টারভিউ।
ইন্টারভিউয়ের জন্য আমাকে ডাকা হয়েছিল সকাল সাতটায়। কোনওমতে ঘুমচোখে
এসে দেখি ব্রেকফাস্টের এলাহি আয়োজন। দুধ কর্নফ্লেক্স থেকে টোস্ট ডিম বেকন থেকে
লুচি আলুর দম থেকে ইডলি দোসা সবকিছু।
খট্কাটা তখনই লেগেছিল। যা বোঝার তখনই বুঝেছিলাম। লোভ সংবরণ
করে শুধু চা-বিস্কুট খেয়েছিলাম সেদিন সকালে।
ইন্টারভিউয়ের কয়েকটা প্রশ্নের উদাহরণ দিই:
ইন্ট্রোফার্ম: এই যে আমাদের দু’টো করে হাত পা চোখ কান, আপনার কি মনে হয় যে
এটা পর্যাপ্ত?
আমি: প্রশ্নই উঠছে না। আমার তো মনে হয়, চারটে করে থাকলেও যথেষ্ট
হত না। মানুষের পুরো স্ট্রাকচারটাই ভুল।
ইন্ট্রোফার্ম: আপনি একসঙ্গে ক’টা টেলিফোন সামলাতে পারেন?
আমি: সাতটা হলে বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আটটাতেও একটু অস্বস্তি
হয়। আমার ধারণা ন’টা হলে ঠিক হয়।
ইন্ট্রোফার্ম: আপনি অবসর সময়ে কী করেন?
আমি: পনেরো বছরের জন্মদিনে আমি অভিধান খুলে “অবসর” শব্দটা কেটে উড়িয়ে
দিয়েছিলাম।
বলাই বাহুল্য, চাকরিটা জুটে গেছিল।
আর পাঁচটা জায়গার থেকে ইন্ট্রোফার্মের ব্যাপারটাই ছিল আলাদা।
আমার বস্ সুনীল রায় ছিলেন স্ট্যানফোর্ডের এমবিএ। হাবেভাবে কথায়বার্তায় বোঝা যেত তাঁর
জ্ঞানের পরিধি, তাঁর দক্ষতা। অনেক কিছু শিখেছিলাম।
তাঁর মত এভাবে হাসতে হাসতে মানুষকে বরখাস্ত করতে আর কাউকে দেখিনি।
একশো স্লাইডের পিপিটি বানাতেন পারতেন আধঘণ্টায়। “প্যারাডাইম চেঞ্জ” বা “প্লীজ ডু
দ্য নীডফুল” বা “সার্কল অফ ডেথ” ছাড়া কথাই বলতেন না।
আরেকটা কথা খুব বলতেন সুনীলবাবু: অ্যাকশন। আমার
জীবনের বীজমন্ত্র হয়ে গেছিল এই অ্যাকশন। সকাল বিকেল রাত এই একটাই শব্দ জপ করতাম। সোম
মঙ্গল বুধ বেস্পতি শুক্র শনি রবি। ছুটি তো এমনিতেই বুঝতাম না, তা সে উইকএন্ড হোক
বা ১৫ই অগাস্ট বা বড়দিন বা দুর্গাপুজো বা দোল।
শুধু অ্যাকশন, অ্যাকশন, অ্যাকশন। ওই যাকে বলে টোয়েন্টিফোর-সেভেন।
একেবারে বিশ্রাম নিতাম না তা নয়। আঠেরো ঘণ্টা অফিসে থাকতাম,
টানা কাজ করলে তো শরীর ভেঙে পড়বে। আর ডেস্কে বসে লাঞ্চ করাও বারণ ছিল। ব্রেক অবশ্যই
নিতাম, ক্যান্টিনে খেতে খেতে, দশটা থেকে সোয়া দশটা, দেড়টা থেকে দু’টো, সাড়ে ছ’টা থেকে
পৌনে সাতটা। তখন হত ম্যানেজমেন্টের ক্লাস। ঐ সুনীলবাবুই নিতেন। সত্যিই, কত কী যে শেখা
বাকি রয়ে গেল!
অ্যাকশন। অ্যাকশন। অ্যাকশন।
সুনীলবাবুকে সরাসরি রিপোর্ট করতেন অনীশ দাস। তাঁকে একরকম
সুনীলবাবুর ডানহাতই বলা চলে। অনেক মানুষ দেখেছি, ঘুমকে এভাবে ঘেন্না করতে কাউকে দেখিনি।
ইন্ট্রোফার্মের কেউ ঘুমোনোর জন্য বাড়ি গেছে শুনলে সেই ঘেন্না তাঁর চোখেমুখে ফুটে উঠত।
ক্ষমতা থাকলে তিনি হয়ত ঘুমন্ত মানুষ দেখলে ফাঁসির হুকুম দিতেন।
অ্যাকশন। অ্যাকশন। অ্যাকশন।
অফিসেই থাকতেন অনীশবাবু। অসম্ভব কর্তব্যপরায়ণ। স্ত্রীর পক্ষাঘাত,
সাত সন্তান, কিন্তু বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ ছিল না তাঁর। জিজ্ঞেস করলেই
বলেন যে বিলাসিতার সময় নেই। কাজের ফাঁকে ফাঁকে জাভা, বটানি, আর স্প্যানিশ সাহিত্যে
পিএইচডিও সেরে ফেলেছিলেন। নাহলে সময় নষ্ট হত।
অ্যাকশন। অ্যাকশন। অ্যাকশন।
একমাসের মধ্যেই আমি ন’টা ফোন বাগিয়ে ফেলেছিলাম। পরের মাসে
সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল দশে। তারপর ক্রমশঃ এগারো, বারো... তরতর করে ধাপে ধাপে এগিয়ে
চলেছিলাম।
অ্যাকশন। অ্যাকশন। অ্যাকশন।
একদিন অ্যাকশন অ্যাকশন করতে করতে দু’টো কিউবিকলের সারির মাঝখানের
আইল দিয়ে হাঁটছিলেন সুনীলবাবু।
হঠাৎই পড়ে গিয়ে মরে গেলেন।
অসম্ভব প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলাম, মনে আছে। অনীশবাবুর
ডেস্কে ছুটে গিয়ে জানিয়েছিলাম ব্যাপারটা।
অনীশবাবুর তখন দু’কানে দু’টো মোবাইল রাবারব্যান্ড দিয়ে বাঁধা,
দাঁতের ফাঁকে কলম, নোট নিয়ে চলেছেন সমানে, তার সঙ্গে দু’হাতে দু’টো কম্পিউটারে টাইপ
করছিলেন। আর তার সঙ্গে পা দিয়ে চালাচ্ছিলেন সেলাই মেশিন।
অ্যাকশন। অ্যাকশন। অ্যাকশন।
গিয়ে সব বলেছিলাম।
“এবার আমরা কী করব তাহলে?” কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন
অনীশবাবু।
“কেন, অ্যাকশন নেব!”
তা অ্যাকশন নিয়েছিলাম। ডেথ সার্টিফিকেট শবযাত্রা শ্মশান শ্রাদ্ধ
নিয়মভঙ্গ ইনশিওরেন্স সমস্ত অ্যাকশন নিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলাম।
খুব খুশি হয়েছিলেন অনীশবাবু, মনে আছে।
স্মরণসভায় আমাকেই বলতে বলেছিলেন তিনি। আর সেদিনই বুঝেছিলাম
যে স্মরণসভায় বক্তৃতা দেওয়ার দক্ষতা আমার সহজাত। অতএব ঝটপট অ্যাকশন নিলাম।
তারপর থেকে এটাই আমার পেশা। অনেক চেষ্টা করেছিলেন অনীশবাবু,
তিরিশটা ফোন অবধি প্রোমোশন অফার করেছিলেন। শুনিনি।
তবে ইন্ট্রোফার্মের কথা মাঝেমধ্যে মনে পড়ে। পুরোনো অফিস, হাজার
হোক।
তবে ইন্ট্রোফার্ম যে ঠিক কী করত সেটা কখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি
সুনীলবাবুকে। সাবানটাবান বানাত বোধহয়।
asadharan!
ReplyDelete