মূল গল্প: Button, Button
লেখক: Richard Matheson
অনুবাদ নয়, “ছায়া অবলম্বনে”
-----
পার্সেলটা
অ্যামাজনের নয়। কে পাঠিয়েছে বারবার উল্টেপাল্টে দেখেও বুঝতে পারল না অগ্নি। কুরিয়র
করতে গেলে সাধারণতঃ কে পাঠাচ্ছে খামের ওপর লিখতে হয়, কিন্তু এক্ষেত্রে সেসবের কোনও
বালাই নেই। কুরিয়র সার্ভিসের নাম অবধি নেই।
তার
ওপর আবার দু’জনের নাম আছে পার্সেলের ওপর। বিয়ের নেমন্তন্ন ছাড়া শেষ কবে দু’জনের
নামে চিঠি বা পার্সেল এসেছে মনে করতে পারল না অগ্নি।
দু’জনের
নামে এলে কি দু’জনের একসঙ্গে খোলা উচিত? নাকি একজন থাকলেই যথেষ্ট?
খুলতে
গিয়েও থেমে গেল অগ্নি। থাক, আসুক মিত্রা, যা করার একসঙ্গেই করবে তারা।
*
একটা
ছোট বাক্স। তার মধ্যে একটা নিরীহ দেখতে সুইচ। সুইচ মানে একেবারে বাড়ির দেওয়ালে সাদামাটা
সুইচবোর্ডে যা থাকে, সেই সুইচ। শুধু সুইচ, তারফার নেই। ব্যাটারিও না। কোনও
ব্র্যান্ডের নামও নেই।
তবে
একটা ভিজিটিং কার্ডমার্কা জিনিস আছে বৈকি। তার ওপর শুধু একটা ফোন নম্বর লেখা, তাও
আবার সতেরো সংখ্যার। শুরুতে ☏ না থাকলে এটা যে ফোন নম্বর তা বুঝতেও পারত না অগ্নি বা মিত্রা।
ব্যাপারটা কী?
পটাপট করে কয়েকবার সুইচটা টিপল মিত্রা। কিছুই
হল না।
“একবার ফোন করে দেখি?”
“ফোন করে কী বলবি? আমাদের বাড়িতে একটা
সুইচ এসেছে?”
“না, মানে...”
“কেউ ট্রোল করছে, অগ্নি।”
“ট্রোল?”
“তোর অফিসে নাহয় বন্ধুবান্ধব নেই, কিন্তু
আমার অফিসে এসব পাবলিকের অভাব নেই।”
“ধরে নিলাম তোর অফিসের কেউ। কুরিয়র
কোম্পানির নাম নেই। সেন্ডারের নাম নেই। একটা অদ্ভুত সুইচ। তারপর একটা ফোন নম্বর – ধরে
নিচ্ছি এটা ফোন নম্বর – তাও আবার সতেরো ডিজিটের। ট্রোল করছে করুক, একটা মানে তো থাকবে?”
“ফোনের ব্যাপারটাই অদ্ভুত লাগছে। দশটা
নম্বর ডায়ল করলেই তো হয় কানেক্ট করবে নয় ডাজ নট একজিস্ট বলবে।”
“করে দেখি?”
“দেখ্। একবার ডাজ নট একজিস্ট বললে কাটিয়ে
দেব।”
*
“এই, বাজছে রে।”
এটা একেবারেই আশা করেনি মিত্রা।
“স্পিকারে দে।”
দিল অগ্নি।
“ফোন করার জন্য ধন্যবাদ। আপনার সুইচ এবার
চালু হল। আপনার কল ট্রান্সফার করা হচ্ছে, লাইনে থাকুন।”
সুইচটার কথা প্রায় ভুলেই গেছিল ওরা। মিত্রা
সবে হাত বাড়াতে যাবে, এমন সময় শুনতে পেল, স্পষ্ট মহিলাকণ্ঠে, “স্পিকারফোনে কথা বলছেন
মানে ধরে নিচ্ছি আপনারা দু’জনেই আছেন।”
“হ্যাঁ।” “হ্যাঁ।”
“ধন্যবাদ। আর কেউ আছে সামনে?”
“না।”
“বেশ। তবে মন দিয়ে শুনুন। পার্সেলের মধ্যে
একটা সুইচও ছিল। ওটার ব্যাপারে বলি এবার।”
“এক মিনিট দাঁড়ান। কে আপনি?”
“সেটা আপনার না জানলেও চলবে। আপাততঃ
এইটুকু ধরে নিন যে পৃথিবীর কেউ নই – তবে ফোন নম্বর থেকে সেটা আশাকরি বুঝে গেছেন
এতক্ষণে।”
ওরা না বুঝে থাকলেও তা নিয়ে বিশেষ
উচ্চবাচ্য করল না।
“অল্প কথায় বলছি। এই সুইচটা টেপার কয়েকদিনের
মধ্যেই আপনারা এক কোটি টাকা পাবেন।”
“সুইচ টিপলে এক কোটি? এটা কীধরনের ইয়ার্কি?”
“আমার কথাটা শেষ করতে দিন। টাকা ছাড়া
আরেকটা ব্যাপারও আছে।”
চুপ।
“টাকাটা আপনারা পাওয়ার আগে আরেকটা ঘটনা ঘটবে।”
চুপ।
“কোনও একজন মারা যাবে সুইচ টেপার আধঘণ্টার
মধ্যে। চিন্তার কিছু নেই, আপনার অচেনা কেউই মারা যাবে। কে মারা যাবে সেটা র্যান্ডমলি
বাছা হবে, তবে ঐ, যা বললা, আপনাদের চেনা মহলের বাইরে।”
“মানে?”
“যা বললাম তাই। আপনি সুইচ টিপলে আপনার
গ্রহে আপনার সম্পূর্ণ অচেনা কেউ মারা যাবে, আর তার পরে আপনি পাবেন এক কোটি টাকা।”
“কিন্তু...”
“কিন্তু?”
“আপনি ডব্লু ডব্লু জেকবসের নাম শুনেছেন?”
“এই ‘মাঙ্কিজ প’ নিয়ে প্রশ্নটা সবাই করছে
কেন বলুন তো? ওটা কল্পনা, এটা বাস্তব। দু’টো এক হল?”
“কিন্তু অত টাকা...”
“ভাববেন না। ব্রিফকেসে ভরে ক্যাশ আসবেনা।
এটা সত্তরের দশকের হিন্দি সিনেমা নয়। পুরো টাকাটাই ট্রান্সফার হবে। ট্যাক্স নিয়ে
সমস্যা হবেনা। তবে হ্যাঁ, সুইচটা একবারই ব্যবহার করতে পারবেন।”
“কিন্তু কোনওভাবে যদি...”
“হঠাৎ করে কিছুতে লেগে সুইচ অন হওয়ার ভয়
নেই। সুইচটা এখন অত সহজে কাজ করবেনা। প্রথমতঃ বেশ জোরে চাপ দিতে হবে, আর সেখানেই শেষ
না। দশ সেকেন্ড ধরে রাখতে হবে।”
“আর যদি ব্যবহার করতে না চাই?”
“একদিন রেখে দিন। এই ফোনটা রাখার ঠিক চব্বিশ
ঘণ্টা পর সুইচটা ডিঅ্যাক্টিভেটেড হয়ে যাবে।”
“কিন্তু এতে আপনার কী লাভ?”
“ওঃ, আমার দরকার ডেটা। আপনাদের ঠিকানা র্যান্ডম
স্যাম্পল হিসেবে এসেছে। আপনাদের গ্রহে মানুষ কীভাবে সাড়া দেয় সেসবের ওপর বেস করে
একটা মডেল ফিট করার প্রজেক্ট আমার ফাইনাল সেমেস্টারে।”
মোবাইলের দিকে তাকাল অগ্নি। ন’টা বেজে সতেরো
মিনিট বাইশ সেকেন্ড।
*
“কী করবি, অগ্নি?”
“কী করব মানে? এই প্রশ্নটা আসছে কীভাবে?”
“না মানে ভাব্, এক কোটি টাকা। এক কোটি।
কটা শূন্য বল্ তো?”
“তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে মিত্রা?”
“না দেখ্, আমরা তো জানতেও পারব না কে
মারা যাচ্ছে। মানে যদি দিনক্ষণের হিসেবও করি তাহলেও প্রতি মিনিটে পৃথিবীতে কত মানুষ
মারা যাচ্ছে জানিস? যদি জানতেও পারি কেউ ঐ সময়ে মারা গেছে, কীভাবে জানব তার মৃত্যুর
জন্য আমিই দায়ী?”
“না, তোর সত্যিই মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
তুই টাকার জন্য খুন করতে চাইছিস্।”
“ড্রামাটাইজ করিস্ না। তুই জানতেও পারবি
না। যে মারা যাবে সে হয়ত এমনিই মারা যাচ্ছিল, না খেতে পেয়ে বা অসুখে ভুগে, অ্যামেরিকা
অ্যাফ্রিকা ইয়োরোপ কোথাও একটা।”
“সেটা পয়েন্ট না। আমার মনে হয়না কারুর অধিকার
আছে অন্যকে মারার।”
“এক কোটি টাকা, অগ্নি। এক কোটি। ভাবতে
পারছিস্?”
“তোর সিরিয়সলি মাথা গেছে। একজন মারা
যাবে। ধর্ এই পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চাদু’টো...”
“চেনা কেউ হবেনা, অগ্নি। অচেনা হবে, বলেছে
তো। একদম অচেনা।”
“কিন্তু ওদের মত কেউ হতে পারে, তাই না? ধর্
এই বিল্ডিঙেই হল। সবকটা ফ্ল্যাটের সব বাচ্চাকে চিনিস তুই?”
“তোর মনে হয় সেটা সম্ভব? পৃথিবীর পপুলেশন
জানিস্? আমাদের বিল্ডিঙে কেউ মারা যাওয়ার প্রব্যাবিলিটি হিসেব কর্।”
“তুই পয়েন্টটা মিস্ করছিস্ মিত্রা। এই
বিল্ডিঙের কেউ নাও হতে পারে। ধর্ অন্য কেউ। ধর্, বাচ্চাও নয়। ধর্, তার টাকায় সংসার
চলে। বা যদি তা নাও হয়, একটা লোককে মেরে ফেলব, জাস্ট টাকার জন্য?”
*
মিত্রা যে খুশি হয়নি সেটা হাবেভাবে বুঝেছিল
অগ্নি। কিন্তু বদ্ধ পাগল না হলে কেউ এধরনের প্রস্তাবে রাজি হয়না। কাল রাত্রে বেশ
অবাকই হয়েছিল অগ্নি। যাক্, আপাততঃ যে বুঝেছে এতেই শান্তি।
হোক না এক কোটি টাকা।
নানান্ মিটিঙে স্লাইডের দিকে সারাদিন মোটামুটি
ঘুমিয়ে কাটাল অগ্নি। সুইচটার কথা ভুলেই গেছিল। ফ্ল্যাটে ঢুকে আলো জ্বালার মনে পড়ল।
ডিনার সেরে ফিরবে মিত্রা। বারোটা হবে। এখন
সাড়ে আটটা।
এক কোটি টাকা। সাতটা শূন্য।
ক্যালকুলেটর খুলে মাইনের অঙ্কটা দিয়ে ভাগ
করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল অগ্নি। অনেক, অনেক বছর লাগবে।
টাকার প্রতি মানুষের চাহিদা থাকাটা স্বাভাবিক।
তবে অর্থলোভ বলতে যা বোঝায় সেটা অগ্নির মধ্যে কোনওদিনই ছিল না। বড় চাকরি দু’জনের
কেউই করে না। যা রোজগার তাতে আইনক্স হয়ে গেলেও পপকর্নটা গায়ে লাগে। মন্দারমণি ছাড়িয়ে
বড়জোর টাকা জমিয়ে আন্দামান হতে পারে, বালি বা কম্বোডিয়া নয়।
এতে অগ্নির অসুবিধে না হলেও মিত্রার হয়।
প্রকাশ করে না ঠিকই, কিন্তু হাবেভাবে বোঝা যায়। কাল রাত্রে বড্ড বেশিই মনে হচ্ছিল।
টাকার জন্য কতটা ডেস্পারেট হলে মানুষ খুন
করতে পিছপা হয়না?
খুন?
খুনই তো। জানতে না পারলেও খুন তো খুনই, তাই
না?
এত টাকার দরকার কীসের? গোটা জীবন তো পড়ে আছে
রোজগার করার জন্য। আজ না হলেও আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু মিত্রা আজই চায়। এক্ষুনি।
স্কুলের বন্ধুদের খানিকটা হিংসেই করে
মিত্রা। ইন্সটাগ্র্যামে বন্ধুদের ছবি দেখে মন্তব্য করে কার কার বাবা বড়লোক। বরের
টাকার কথাটা বলে না বটে, কিন্তু অগ্নি নিশ্চিত যে মনে মনে ভাবে।
ভাল লাগে না অগ্নির। এতটা ছিল না বিয়ের আগে,
মনে পড়ল।
ধুর্, এত কেন ভাবছে অগ্নি? ন’টা বাজে,
এবার চানটান করে খাবার গরম করলে বরং কাজে দেবে।
ন’টা বাজে। ন’টা।
আর সতেরো মিনিট বাইশ সেকেন্ড। না, বাইশ
সেকেন্ড নেই আর।
সুইচটা হাতে নিয়ে ঠায় বসে রইল অগ্নি, ঘড়ির
দিকে তাকিয়ে।
নিজের টাকার লোভ নেই ঠিকই, কিন্তু
ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স একটা তৈরি হয়েছে বৈকি বিয়ের পর। এই যে পদে পদে মিত্রার
চাহিদা, এক কোটি টাকা পেলে সেটা অনায়াসে মিটে যাবে, তাই না?
বালি-কম্বোডিয়া কেন, অ্যালাস্কা ক্রুজও
হয়ে যাবে।
কিন্তু একটা নিরীহ মানুষকে...
ন’টা পাঁচ।
প্রব্যাবিলিটির কথা বলছিল না মিত্রা? পৃথিবীর
কত লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকে। মরতে চাইলেও মরতে পারে না, মনের জোর পায়না।
তাদের একজন মরতে পারে আজ। হতেই পারে। আর
মরলেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এক কোটি টাকা।
ন’টা দশ।
খুব অন্যায় হবে সুইচটা টিপলে? নিজের তো
দরকার নেই টাকার। এটা তো মিত্রার জন্য করছে সে। মিত্রাকে খুব ভালবাসে অগ্নি।
অচেনা কেউ। আজ অপরাধবোধ হলেও কতদিন মনে থাকবে?
তিনমাস? ছ’মাস? একবছর? তারপর?
মিত্রা খুব চায় টাকাটা। খুব তাড়াতাড়ি জীবনে
অনেক কিছু করে ফেলতে চায়।
ন’টা পনেরো।
মিত্রার মুখটা মনে পড়ল অগ্নির। জয়েন্ট
অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়লে মেসেজটা দেখে মিত্রার মুখ কীভাবে উদ্ভাসিত হবে জানে সে।
অনেকদিন তাকায়নি মিত্রা ঐভাবে।
অচেনা তো। হবেনা কিছু। জানতেও পারবেনা কোনওদিন।
ন’টা বেজে ষোল মিনিট বাইশ সেকেন্ডের মাথায়
সুইচটা টিপল অগ্নি। দশ সেকেন্ডের বেশিই ধরে রইল।
*
“আপনার নামে এফআইআর করব আমি।”
“আপনি জানেন তাতে লাভ নেই। আমি আপনাদের গ্রহের
হলেও কিচ্ছু প্রমাণ করতে পারতেন না আপনি। অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। আর হ্যাঁ, আপনি ইনশিওরেন্সের
এক কোটি টাকা পাননি?”
“আপনি বলেছিলেন অচেনা কেউ। আপনি কথা দিয়েছিলেন।”
“পার্সেলটা পাওয়ার আগে অবধি আপনি সত্যিই
চিনতে পেরেছিলেন আপনার স্ত্রীকে?”
just kichhu bolar nei..kurnish....
ReplyDelete